বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মরত আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতনে ফুলছে ১৩ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকের পেট

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ সচিবালয়ে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন আওলাদ হোসেন। সরকারি নথি অনুযায়ী তিনি মাসিক ১৭ হাজার ৯১০ টাকা বেতন পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তিনি বেতন পাচ্ছেন চৌদ্দ হাজার টাকা। বাকি ৩ হাজার ৯১০ টাকা চলে যাচ্ছে তাকে নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারের পেটে। প্রায় প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করেও মিলছে না অতিরিক্ত পারিশ্রমিক।


বিজ্ঞাপন

দেওয়া হচ্ছে না নিয়মিত বেতনও : 


বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের ৫ নভেম্বর থেকে সহকারী মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন রকিব চৌধুরী। কাগজে-কলমে তিনিও ১৭ হাজার ৯১০ টাকা বেতন পান। কিন্তু বাস্তবে পাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা। বাকি ২ হাজার ৯১০ টাকা ‘গিলে খাচ্ছে’ তাকে নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কনা কারিগর। রকিবও প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করেও পাচ্ছেন না অতিরিক্ত পারিশ্রমিক। প্রতি মাসে ঠিকাদারকে দিতে হচ্ছে চুক্তির অতিরিক্ত টাকা।

রকিব চৌধুরী গণমাধ্যম কে বলেন, এর আগে আকিবুল হাসান পলাশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি তখন তিনি মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতন দিতেন। বাকিটা নিজে রেখে দিতেন। এখন যে ঠিকাদার আছেন তিনিও ২ হাজার ৯১০ টাকা প্রতি মাসে রেখে দেন। আমাদের সবাই ঠকায়!

চাকরিতে প্রবেশের পর তাদের ব্যাংক হিসাবে সরকার নির্ধারিত বেতন ঢুকলেও পরদিনই সে বেতনের চুক্তির অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান চেকবই তাদের নিজেদের কাছে রেখে দেয়। ফাঁকা চেকবইয়ে কর্মচারীদের স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন করে দেয় নির্ধারিত বেতনের কম টাকা।

বাকিটা গিলে খাচ্ছে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান: 

২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে লিফটম্যান হিসেবে কাজ করছেন মো. হিরা। এ কাজের জন্য সরকার তার জন্য মাসিক ১৭ হাজার ৬১০ টাকা বেতন ধার্য করলেও তিনিও পাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা যাচ্ছে তাকে নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আজিজ অ্যান্ড কোং-এর মালিক সজল কুণ্ডুর পকেটে।

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা হলে লিফটম্যান হিরা বলেন, আমাদের চলতি মাসসহ পাঁচ মাসের বেতন বাকি। কবে বেতন দেবে জানি না। আমাদের চেকবইও তারা আটকে রেখেছে। চেকবই দিয়ে তারাই বেতন তোলে। আগে থেকেই আমাদের সই নিয়ে রাখে এসব চেকবইয়ের পাতায়। চেকবই চাইলে তারা চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেয়। ফলে চাকরি বাঁচাতে কম বেতন নিয়েও চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।

আলোর মুখ দেখে না মন্ত্রণালয়ে দায়ের করা অভিযোগ : 

এমন ঘটনার সাক্ষী শুধু আওলাদ হোসেন, রকিব চৌধুরী কিংবা মো. হিরাই নয়, গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চার শতাধিক আউট সোর্সিং কর্মীর ‘ঠকে’ যাওয়ার তথ্য।

প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রায় ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা-২০১৮ এর আলোকে জনবল সরবরাহ করছে। এদের মধ্যে প্রাণ আরএফএল ছাড়া বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নিয়মিতই চুষে খাচ্ছে নিম্নআয়ের এসব মানুষের ঘাম ঝরা আয়ের পয়সা।

অনুসন্ধান বলছে, নীতিমালা অনুযায়ী জনবল সরবরাহের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো মোট জনবলের বেতনের ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত অর্থ পায়। এরপরও বছরের পর বছর নিম্নআয়ের শ্রমিকদের বেতনের একটি অংশ নিয়ে নিচ্ছে তারা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবল সরবরাহের সময় সরকার-নির্ধারিত বেতনের কম বলে কর্মীদের নিয়োগ দিচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ হবে বলে কর্মচারীদের জানায়। কিন্তু আসলে কোথায় এই খাত, সে উত্তর চাইলেও মেলে না। চাকরিতে প্রবেশের পর তাদের ব্যাংক হিসাবে সরকার-নির্ধারিত বেতন ঢুকলেও পরদিনই সে বেতনের চুক্তির অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান চেকবই তাদের নিজেদের কাছে রেখে দেয়। ফাঁকা চেকবইয়ে কর্মচারীদের স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন করে তারা। আর কর্মীকে দেয় নির্ধারিত বেতনের কম টাকা। আবার কোনো কোনো ঠিকাদার ইচ্ছা করে বেতনও বকেয়া রাখে। এতে একদিকে নিম্নআয়ের এসব চাকরিজীবীদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর অন্যদিকে কর্মচারীদের কাছ থেকে নেওয়া অবৈধ অর্থে বিত্ত-বৈভব গড়ছেন ঠিকাদাররা।

কারা গিলে খাচ্ছে এসব টাকা?

প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রায় ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা-২০১৮ এর আলোকে জনবল সরবরাহ করছে। এদের মধ্যে প্রাণ আরএফএল ছাড়া বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নিয়মিতই চুষে নিচ্ছে নিম্নআয়ের এসব মানুষের ঘাম ঝরা আয়ের পয়সা। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো- ইস্টান এন্টারপ্রাইজ, কনা কারিগর, প্রায়ন্তী এন্টারপ্রাইজ, শুভ্রা ট্রেডার্স, ইকবাল এন্টারপ্রাইজ, ইউনিভার্সেল এন্টারপ্রাইজ, মান বাংলাদেশ, ক্রিয়োটিভ এন্টারপ্রাইজ, আজিজ অ্যান্ড কোং, রশিদ এন্টারপ্রাইজ, ড্যাফোডিল এন্টারপ্রাইজ, রিমন এন্টারপ্রাইজ এবং ধলেশ্বরী এন্টারপ্রাইজ।

আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮ এর ৭ এর (১) এ বলা হয়েছে- ‘সেবা প্রদানকারী অতিরিক্ত সময় সেবাদানে নিয়োজিত থাকলে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত সেবা মূল্য প্রদেয় হবে’। নীতিমালা অনুযায়ী কর্মচারীদের ওভারটাইমের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের বিধান থাকলেও নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করেও এসব কর্মচারীদের কেউই কানাকড়িও পাচ্ছেন না

মাসে কত কত টাকা নিচ্ছে তারা?

জনবল সরবরাহ করা এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি তাদের কর্মচারীদের প্রতি মাসে জনপ্রতি ২ হাজার ৯১০ টাকা করে কম দিচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৯১০ টাকা এবং কিছু প্রতিষ্ঠান ৯ হাজার টাকা করে কম দিচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী চার শতাধিক কর্মচারীকে গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা কম দেওয়া হচ্ছে। এতে গড়ে প্রতি মাসে ২৮ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে তারা। বছর ঘুরলে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার বেশি! এসব টাকার একটি অংশ চলে যায় টেন্ডার পেতে সহায়তা করা নির্বাহী প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে।

জাদুচক্রে আটকা ‘টেন্ডার’ : 

একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করার প্রক্রিয়া থাকলেও বছরের পর বছর ঘুরে ফিরে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই চুক্তি নবায়ন করছে। এ চক্রের বাইরে অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে জনবল সরবরাহের নজির বিরল। বেশিরভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক দশকের বেশি সময় ধরে এককভাবে এসব চুক্তি নবায়ন করে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষদের কষ্টের অর্থ চুরি করছে।

নিম্নআয়ের এসব কর্মচারীর চেকবই বেশিরভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আটকে রাখে। এসব চেকবইয়ে আবার অগ্রিম স্বাক্ষরও নেওয়া হয়। দুই তিনমাস পর বেতন পেলে সেসব চেকবই দিয়েই উত্তোলন হয় টাকা। চুক্তির অতিরিক্ত টাকা কেটে রেখে দেওয়া হয় বাকি বেতন। অথচ দেশের আইন অনুযায়ী এমন হঠকারী চুক্তি আইনিভাবে অপরাধ, টেন্ডারের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রেও নেওয়া হয় অভিনব কৌশল। দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকগুলোতে টেন্ডার আহ্বান না করে তেমন প্রচার নেই এমন কিছু পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এককভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া চালানো হয়।

অতিরিক্ত কাজ করেও ‘ওভারটাইম’ পান না : 

আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮-এর ৭ (১) এ বলা হয়েছে- ‘সেবা প্রদানকারী অতিরিক্ত সময় সেবাদানে নিয়োজিত থাকলে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত সেবা মূল্য প্রদেয় হবে’। অর্থাৎ ‘ওভারটাইমে’র জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু এই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন সচিবালয়ের কর্মীরা। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করেও তারা কেউ কোনো অর্থ পাচ্ছেন না। ফলে এ খাত থেকেও প্রতি মাসে সেবা সরবরাহকারী এসব রাঘববোয়ালরা গিলে খাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ঈদ কিংবা পূজায় বছরের কোনো উৎসবেই এসব শ্রমিকদের বোনাসও দেওয়া হয় না।

দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অপকর্ম নিয়ে গত ২১ আগস্ট গণপূর্ত উপদেষ্টা বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী কর্মীরা। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি
রাশেদুল ইসলাম নামে এক শ্রমিক বলেন, আমাদের অনেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করে। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের জন্য এক পয়সাও দেওয়া হয় না। শুক্রবারও অনেক সময় ডিউটি করতে হয়। এই যে অতিরিক্ত কাজ আমরা করছি সেগুলোর টাকা কেউই পাচ্ছি না।

নিয়োগেও নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ !

জানা গেছে, চাকরি প্রত্যাশীদের আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগের সময়ও নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ক্ষেত্রবিশেষে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এমন একাধিক অভিযোগের প্রমাণ গণমাধ্যমের হাতে আছে। উপায়ন্তর না পেয়ে গরিব মানুষেরা ‘টাকা দিয়ে’ই চাকরি নেয়। অনেকে এজন্য ঋণ নেয়, পরে ঋণের কিস্তি দিতে দিতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়।

কথা বললেই চাকরি নেই, কেড়ে নেওয়া হয় সচিবালয়ের পাসও : 

ভুক্তভোগী আউটসোর্সিং কর্মচারীরা গণমাধ্যম কে বলছেন, অনিয়মের বিষয়ে কথা বলার কেউ নেই। রক্তচোষা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বললেই দেওয়া হয় চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি। কেড়ে নেওয়া হয় সচিবালয়ে প্রবেশের পাসও। বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয় হয়রানির হুমকি। লিফটে দায়িত্বরতদের কেউ ডিউটির ফাঁকে শৌচাগারে গেলেও শুনতে হয় গালমন্দ।

আকিবুল হাসান পলাশ (প্রায়ন্তি এন্টারপ্রাইজের মালিক) সচিবালয়ের ঠিকাদারি চক্রের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক দুলাল এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের সঙ্গে পলাশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তারা সবাই জামালপুরের লোক। সচিবালয়ে তিনি জামালপুরের অনেককে নিয়োগ দিয়েছেন। এলাকায় গড়েছেন অনেক সম্পত্তি
সাখাওয়াত নামে এক লিফটম্যান গণমাধ্যম কে বলেন, আমাদের জীবনে স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। এত অনিয়ম দেখার পরও কিছু বলতে পারি না। বলতে গেলেই চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়। ভয়ে নিজেদের অধিকারটুকুও চাইতে পারি না। তিনি বলেন, আমাদের এখানে যেসব নারী কাজ করেন তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটিও দেওয়া হয় না। একজন নারী বেতন ছাড়া এই সময় কীভাবে চলবে?

বেহাত থাকে চেকবই, চার মাস গেলেও মেলে না এক মাসের ‘বেতন’ : 

আ্র্উট সোর্সিং কর্মচারীদের চেকবই বেশিরভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আটকে রাখে। এসব চেকবইয়ে অগ্রিম স্বাক্ষর নেওয়া হয়। দুই-তিনমাস পর বেতন পেলে সেসব চেকবই দিয়ে উত্তোলন করা হয় টাকা। চুক্তির অতিরিক্ত টাকা কেটে রেখে দেওয়া হয় বাকি বেতন।

আমাদের জীবনে স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। এত অনিয়ম দেখার পরও কিছু বলতে পারি না। বলতে গেলেই চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়। ভয়ে নিজেদের অধিকারটুকুও চাইতে পারি না সাখাওয়াত, লিফটম্যান, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতি চার মাস পরপর এক বা দুই মাসের বেতন দেয়। খুব প্রয়োজনে কেউ পাওনা বেতনের টাকা চাইলেও দেওয়া হয় না। ফলে যথাসময়ে বাসা ভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে নানা সমস্যা হয়।

রবিউল ইসলাম নামে এক আউটসোর্সিং কর্মী গণমাধ্যম কে বলেন, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা খুব অসুস্থ হন। জরুরিভিত্তিতে গ্রামে যাওয়া এবং বাবার ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন পড়ে। পরদিন আমার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ফখরুল আজীমকে পাওনা বেতন থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে বলি। আমার বাবার অসুস্থতার কথা বলি, তবুও আমাকে একটা পয়সাও দেননি তিনি। ৬ দিন পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা মারা যান। এ দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারি না, এটাই আমাদের চাকরি!

চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা খুব অসুস্থ হন। পরদিন আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ফখরুল আজীমকে পাওনা বেতন থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে বলি। আমার বাবার অসুস্থতার কথা বলি, তবুও আমাকে একটা পয়সাও দেননি তিনি। ৬ দিন পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা মারা যান। এ দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারি না, এটাই আমাদের চাকরি।

আউটসোর্সিং শ্রমিকের অভিযোগেও মেলেনি সুরাহা : 

দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অপকর্ম নিয়ে গত ২১ আগস্ট গণপূর্ত উপদেষ্টা বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী কর্মীরা। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। অভিযোগের ভিত্তিতে গণপূর্ত উপদেষ্টা তৎকালীন সচিব মো. নবীরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন। ওই পর্যন্তই, প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে অভিযোগ দায়েরকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং কর্মীদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখায়।

এ প্রসঙ্গে নয়ন নামে এক শ্রমিক গণমাধ্যম এর কাছে হতাশাব্যাঞ্জক ভাবে বলেন, অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে আমাদের ওপর মানসিক অত্যাচার ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দ্বিগুণমাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। আমরা কি এই দেশে বিচারও চাইতে পারব না? আমাদের আর্তনাদ শোনার কি কেউ নেই? অভিযোগ দেওয়া হয়েছে অনেকদিন হলো, এখনো কোনো সমাধান আসেনি। এভাবেই চলছে।

গতি নেই তদন্ত কমিটির : 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারদের অনিয়মের বিরুদ্ধে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ কমিটি গঠনের ২২ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। নেওয়া হয়নি দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপও।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাকিলা জেরিন আহমেদ গণমাধ্যম কে বলেন, এটা নিয়ে কাজ চলছে। নথিপত্র দেখে বলতে হবে প্রতিবেদন কতদূর। বিশেষ পরিস্থিতিতে এতদিন টাকা নেওয়া হয়েছে।

নির্ধারিত পরিমাণ বেতন না দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। পরে আমি ঠিকাদারদের ডেকেছি। তাদের সতর্ক করেছি। তাদের বলেছি তারা যদি আবার এ ধরনের অপরাধ করে থাকে তাহলে তাদের চুক্তি বাতিল করা হবে।

নিয়াজ মোহাম্মদ তানভীর আলম, নির্বাহী প্রকৌশলী, সচিবালয় : 

এ বিষয়ে সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়াজ মোহাম্মদ তানভীর আলম গণমাধ্যম কে বলেন, নির্ধারিত পরিমাণ বেতন না দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। পরে আমি ঠিকাদারদের ডেকেছি। তাদের সতর্ক করেছি। তাদের বলেছি তারা যদি আবার এ ধরনের অপরাধ করে তাহলে তাদের চুক্তি বাতিল করা হবে। তারা বলেছে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এতদিন টাকা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন থেকে আর নেওয়া হবে না। এই মর্মে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আমি অভিযুক্ত কিছু প্রতিষ্ঠানের বিল আটকে রেখেছি।

ঠিকাদারি ‘শোষণে’র শেষ চান আউটসোর্সিং কর্মীরা : 

বছরের পর বছর চলতে থাকা ঠিকাদারদের এসব অনিয়ম, আধুনিক দাসত্ব ও বেতনবৈষম্য থেকে মুক্তি চান ভুক্তভোগী কর্মীরা। তারা বলছেন- আমরা চাই ঠিকাদারি এই শোষণের অবসান হোক। আমাদের রক্ত পানি করা বেতনের টাকা অন্য কেউ খেতে না পারুক। দীর্ঘদিন তারা আমাদের কাছ থেকে যে অর্থ অন্যায়ভাবে নিয়েছে সেগুলো ফেরত দিতে রাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ নিক। অন্তত সচিবালয়ে ঠিকাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতায় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা হোক। এমন দুর্বিষহ ব্যবস্থার অবসান হোক।

দায় এড়াতে চান ঠিকাদাররা : 

নিয়মের তোয়াক্কা না করে আইনবহির্ভূতভাবে শ্রমিকদের বেতন কম দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন-এর মালিক মো. শাহ আলম গণমাধ্যম কে জানান, আমাদের এক মাসের বেতন দিতে পারিনি এখনো। এক মাস বাকি থাকতে পারে। তবে নির্ধারিত বেতনের চেয়ে আমরা কম বেতন দিই না। এখানে ১৩টির মতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে। তাদের কেউ কেউ এটা করতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক সময় একজন কর্মচারী নিয়োগে মন্ত্রী বা সচিবরাও সুপারিশ করেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রী-সচিবদের আশেপাশে থাকা অনেকে আমাদের চাপ দিয়ে জনবল নিতে বাধ্য করেছে। তারা এসব জনবল দিয়ে এক থেকে দুই লাখ করে টাকা নিয়েছে। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে আমি জেনেছি, মাত্র এক বছরের চুক্তির মেয়াদের এই চাকরিতেও ঘুষ দিতে হয়েছে। আমরা কোনো ঘুষ নিই না।

এ প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কনা কারিগরের মালিক মো. পারভেজ কামাল গণমাধ্যমে বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খাতে কিছু টাকা খরচ হয়। সেটা সমন্বয় করতে অনেক সময় কর্মচারীদের সাথে পরামর্শ করে কিছু টাকা সমন্বয় করা হয়। সবসময় বেতন কম দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, সরকারের নিয়ম অনুযায়ীই তাদের বোনাস নেই; ছুটি নেই। এক্ষেত্রে ঠিকাদারদের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।

এই অভিযোগ আমি যোগদানের আগেই দিয়েছে। এটা নিয়ে তদন্ত চলছে। সমস্যাটির সমাধান না হলে আমরা শক্ত পদক্ষেপ নেব
মো. হামিদুর রহমান খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব
ঠিকাদার প্রায়ন্তি এন্টারপ্রাইজের মালিক আকিবুল হাসান পলাশকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার গণমাধ্যম কে  বলেন, আকিবুল হাসান পলাশ (প্রায়ন্তি এন্টারপ্রাইজের মালিক) সচিবালয়ের ঠিকাদারি চক্রের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক দুলাল এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের সঙ্গে পলাশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তারা সবাই জামালপুরের লোক। সচিবালয়ে তিনি জামালপুরের অনেককে নিয়োগ দিয়েছেন। এলাকায় গড়েছেন অনেক সম্পত্তি।

কী বলছেন গণপূর্ত সচিব?

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান গণমাধ্যম কে বলেন, এই অভিযোগ আমি যোগদানের আগেই দিয়েছে তারা। এটা নিয়ে তদন্ত চলছে। সমস্যাটির সমাধান না হলে আমরা শক্ত পদক্ষেপ নেব।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *