বিশেষ প্রতিবেদক : বাংলাদেশ একটি সম্প্রীতির দেশ। এখানে মসজিদের আজান, মন্দিরের ঘণ্টা, গির্জার প্রার্থনা এবং বৌদ্ধবিহারের শান্তি সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। এই দেশ শুধু গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক নয়, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরও পথপ্রদর্শক। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে, ভারতীয় গণমাধ্যমে আমাদের এই দেশকে হিন্দুবিদ্বেষী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার এক পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই প্রচারণা শুধু মিথ্যা নয়, বরং দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
ভারতীয় মিডিয়ার সাম্প্রতিক আচরণ একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেয়। এটি কেবল সাংবাদিকতার ব্যর্থতা নয়, বরং ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী শাসনের কৌশল। তাদের রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো ‘বিদেশি শত্রু’ তৈরি করা। আর বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ‘হিন্দুদের রক্ষক’ সেজে নিজেদের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ উসকে দেওয়া সেই কৌশলেরই অংশ।
৫ আগস্টের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে যেভাবে ভারতীয় গণমাধ্যম ঘটনাগুলোকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে, তা হতাশাজনক। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে যে সাময়িক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তার সুযোগ নিয়ে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। এগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক হলেও, ভারতীয় মিডিয়া এগুলোকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে চিত্রিত করেছে। বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি মিডিয়া আউটলেট এবং সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলার শিকারদের বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া এই ঘটনাগুলোকে ‘হিন্দু হত্যা’ এবং ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
এই অপপ্রচারের পেছনে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। এটি বাংলাদেশবিরোধী ন্যারেটিভ তৈরির মাধ্যমে ভারতের ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী শক্তি নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ‘বাংলাদেশফোবিয়া’কে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনকে চীন, পাকিস্তান বা যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র হিসেবে তুলে ধরা ভারতীয় মিডিয়ার আরেকটি প্রবণতা। এটি শুধু ভিত্তিহীন নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে উপেক্ষা করার শামিল। বাংলাদেশের ইতিহাস গৌরবময় গণআন্দোলনের। ৫ আগস্টের পরিবর্তন সেই ধারারই একটি উদাহরণ। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম তা স্বীকার না করে আমাদের জনগণের ইচ্ছাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে।
তাদের দায়িত্বহীনতা এখানেই শেষ হয়নি। ইসকনের সাবেক এক নেতার গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলাদেশবিরোধী উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা পর্যন্ত হয়েছে, তা প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার প্রচেষ্টার পরিপন্থী।
ভারতীয় মিডিয়ার আরেকটি সমস্যা হলো মিথ্যা বা ভুয়া তথ্য প্রচার। শিব মূর্তি ভাঙার একটি ভিডিও, যা ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের বলে দাবি করা হয়, সেটি পরে ভারতের সুলতানপুরের ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত হয়। এই মিথ্যাচার সাংবাদিকতার নীতি লঙ্ঘনের পাশাপাশি দুই দেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ানোর প্রচেষ্টা।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে—ভারতীয় মিডিয়া কেন এমন করছে? এটি কি কেবল ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির হাতিয়ার, নাকি প্রতিবেশী বাংলাদেশকে আঞ্চলিক রাজনীতির শিকার বানানোর একটি কৌশল?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, এবং এটি তার জনগণের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া ও তাদের ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারকে মেনে নিতে ব্যর্থ। তারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা শক্তিশালী করতে আমাদের দেশকে শত্রু হিসেবে চিত্রিত করতে চায়।
বাংলাদেশ কোনো দুর্বল প্রতিবেশী নয়। আমাদের জনগণ তাদের অধিকার রক্ষায় বরাবরই ঐক্যবদ্ধ। ভারতীয় গণমাধ্যমের এই প্রচারণা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। তবে এটি দুই দেশের সম্পর্ককে দূরে ঠেলে দিতে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের উচিত হবে মিথ্যাচার বন্ধ করা এবং সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিগুলোতে ফিরে যাওয়া। ক্ষমতার রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে ওঠার পরিবর্তে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকার এখনই সময়। সত্যের শক্তি যে মিথ্যার চেয়ে অনেক বেশি টেকসই, তা ভারতীয় মিডিয়াকে উপলব্ধি করতে হবে। সম্পর্ক কেবল তখনই টিকে থাকে, যখন তা সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। (তথ্য সুত্র ও ছবি : ইনফো -বাংলা)