নিজস্ব প্রতিনিধি (যশোর ও রাজশাহী) : রাজশাহীর দুর্গাপুরে সম্প্রতি (১৯ জানুয়ারি) সরকার অনুমোদিত কয়েকজন পরিবেশকের (ডিলার) গুদামে গিয়ে এক ছটাকও টিএসপি পাওয়া যায়নি। পরপর কয়েকজন পরিবেশকের গুদামে গিয়ে একই অবস্থা দেখা গেল। অথচ পাশেই খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গিয়ে ঠিকই এই সার পাওয়া গেল। তবে দাম ৫০ কেজির বস্তায় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বেশি।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তাঁরা ডিলার নন; অন্য জায়গা থেকে এই সারের ব্যবস্থা করেছেন। নির্ধারিত পরিবেশক ছাড়া এভাবে অন্য কোনো উৎস থেকে আনা সারই ‘বরাদ্দবহির্ভূত’ সার। রাজশাহী ও যশোরে যত্রতত্র খুচরা বিক্রেতারা বরাদ্দবহির্ভূত সারের নামে বেশি দামে চাষিদের কাছে নন-ইউরিয়া (টিএসপি-ডিএপি-এমওপি) সার বিক্রি করছেন। পরিবেশকের কাছে সার না পাওয়ায় চাষিরাও সেই সার বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষায়, কোনো এলাকার বরাদ্দ করা সার বন্যা বা অন্য কারণে সেখানে কাজে না লাগলে যদি অন্য এলাকায় ঢোকে, তখন সেই সারকে ‘বরাদ্দবহির্ভূত’ সার বলা হয়। অথচ নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পরিবেশক ও নির্ধারিত খুচরা সার বিক্রেতা ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী সার বিক্রি করতে পারবেন না। সরকার নির্ধারিত পরিবেশক ও বিক্রেতারা ছাড়া কেউ অনুমোদিত উৎস ব্যতীত অন্য কোনো উৎস থেকে সার সংগ্রহ কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন না।
বোরো মৌসুমের শুরুতে সার পাচ্ছেন না কৃষক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, রাজশাহীতে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ১৫৯ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন নন-ইউরিয়া সার ঢুকেছে। কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তাঁরা এসব সার সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রির জন্য তদারকি করেন। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, খুচরা বিক্রেতারা কোথাও নির্ধারিত দামে নন-ইউরিয়া সার বিক্রি করছেন না। অনুমোদিত পরিবেশকেরা এসব সার প্রান্তিক চাষিদের কাছে অল্প পরিমাণে বিক্রি করলেও সঙ্গে ইউরিয়া নিতে বাধ্য করছেন বলে চাষিদের অভিযোগ। পরিবেশকদের কাছে চাহিদামতো সার না পেয়ে চাষিরা খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
কোথাও কোথাও পরিবেশকেরা দালালদের মাধ্যমে এই সার বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। গত দেড় মাসে যশোরে সার পাচারের সময় ৫ হাজার ৭৪৫ বস্তা অ-ইউরিয়া সার আটক করে থানায় মামলা করেছে পুলিশ। রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় পরিবেশকদের জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাইরে এসে ওই সার ‘বরাদ্দবহির্ভূত’ নামে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, কৃষক পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত প্রতি বস্তা টিএসপির খুচরা মূল্য ১ হাজার ৩৫০ টাকা (২৭ টাকা কেজি), এমওপি এক হাজার টাকা (২০ টাকা কেজি) ও ডিএপি এক হাজার টাকা (২১ টাকা কেজি)। প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২৭ টাকা।
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল বোরো মৌসুম। বোরোর বীজতলা তৈরির সময় ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। বোরোর চারা রোপণের সময় ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি। এ সময়ে মূলত নন-ইউরিয়া সারের ব্যবহার হয়। চারা রোপণের পর ইউরিয়া সার লাগে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে চাষিরা পরিবেশকদের কাছে নন-ইউরিয়া সার পাচ্ছেন না। সংকটের কারণে বাইরে থেকে তাঁদের চড়া দামে কিনতে হচ্ছে।
সার তুলে নিচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
দেশের সবচেয়ে বড় সার বিপণন কেন্দ্র যশোরের নওয়াপাড়া। এখান থেকে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সার যায়। নওয়াপাড়ায় দুই শতাধিক ক্ষুদ্র সার ব্যবসায়ী আছেন। বেশির ভাগ সারের পরিবেশক নওয়াপাড়ায় না গিয়ে এই ক্ষুদ্র সার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কাগজে-কলমে সার উত্তোলন দেখিয়ে বরাদ্দের অধিকাংশ সার আমদানিকারক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এ ছাড়া বিএডিসির অনেক পরিবেশক কাগজে-কলমে বরাদ্দের সার উত্তোলন দেখিয়ে অধিকাংশ সার বিএডিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তার কাছে বিক্রি করছেন।
গত ১ ও ২ ডিসেম্বর নওয়াপাড়ার বিভিন্ন ঘাট থেকে রাজবাড়ীর দুজন ও কুষ্টিয়ার একজন বিসিআইসি পরিবেশক বেসরকারি আমদানিকারকের কাছ থেকে বরাদ্দের ৩ হাজার ১৮৫ বস্তা ও উৎসবিহীন ৪০০ বস্তা ডিএপি নিজ এলাকায় না নিয়ে ট্রাকে করে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়ার সময় কৃষি কর্মকর্তারা আটক করেন। এ ঘটনায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রসেন মণ্ডল বাদী হয়ে ৩ ডিসেম্বর ওই তিন পরিবেশকের বিরুদ্ধে অভয়নগর থানায় মামলা করেন।
গত ৭ জানুয়ারি নড়াইলের একজন পরিবেশক বিএডিসির বরাদ্দের ৪০০ বস্তা ডিএপি ট্রাকে চুয়াডাঙ্গায় নেওয়ার সময় যশোরের পালবাড়ি মোড়ে আটক হন। অভয়নগরের চেংগুটিয়া বাজারে গত ১৩ জানুয়ারি বরাদ্দবহির্ভূত ১৪৫ বস্তা টিএসপি, ১১৯ বস্তা ডিএপি, ৩০৪ বস্তা এমওপি এবং ১০০ বস্তা ইউরিয়া সার বেশি দামে বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই ব্যবসায়ীকে এক লাখ করে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন। অভয়নগরের কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন গণমাধ্যম কে জানান, দুই ব্যবসায়ীর সার বিক্রির নিবন্ধন ছিল না। তাঁরা বরাদ্দবহির্ভূত সার মজুত করে বেশি দামে বিক্রি করছিলেন। সেই সার জব্দ করা হয়েছে।
গত ১৫ জানুয়ারি রাতে অভয়নগরে চারটি ট্রাকে মোট ১ হাজার ৭৬০ বস্তা ডিএপি সার অন্যত্র পাচারের সময় আটক করেন অভয়নগরের কৃষি কর্মকর্তা। এ ঘটনায় করা মামলার আসামি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মেসার্স এস এস এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কালাম উদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে এজাহারে ৪৫০ মেট্রিক টন সার অন্যত্র বিক্রির অভিযোগ করা হয়।
সরেজমিন যা দেখা গেল
গত ১৯ জানুয়ারি দুর্গাপুরের বেলঘরিয়া বাজারে কালামের গুদামে গিয়ে ব্যবস্থাপক মাসুদ রানাকে পাওয়া যায়। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাঁদের জানুয়ারি মাসের বরাদ্দের অর্ধেক সার ইতিমধ্যে আনা হয়েছে। এটা মিথ্যা মামলা। তবে তাঁদের নভেম্বর মাসের ডিএপি সার বিক্রির কয়েকটি রসিদ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে বেশ কয়েকজন ক্রেতাকে ফোন করলে তাঁরা সার কিনেছেন বললেও পরিমাণ জানাতে পারেননি।
একটি রসিদে উপজেলার খাসখামার এলাকার এনামুল নামের এক কৃষকের নামে ৪০ বস্তা সার বিক্রি দেখানো হয়েছে। এনামুল গণমাধ্যম কে বলেন, তিনি ওই দোকান থেকে ৪০ বস্তা সার কেনেননি। আট কিলোমিটার দূরে এনামুলের বাড়িতে গিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা রসিদের ফটোকপি দেখালে তিনি দাবি করেন, ‘স্বাক্ষর আমার না। সর্বোচ্চ ১৫ বস্তা সার কিনেছি। ৪০ বস্তা কেনার প্রশ্নই ওঠে না।’ তবে দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহারা খাতুন দাবি করেন, তিনি গুদামে মজুত দেখেই আগমনী বার্তায় (অ্যারাইভাল রিপোর্ট) সই করেছেন।
দুর্গাপুর থেকে পাশের পুঠিয়া উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে খুচরা বিক্রেতা ফয়সাল ট্রেডার্সে টিএসপিসহ সব ধরনের সার পাওয়া গেল। সারের বস্তার সরকার নির্ধারিত দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা হলেও তাঁরা বিক্রি করছেন ২ হাজার ৩৫০ টাকা, তিউনিসিয়ার টিএসপি ১ হাজার ৮০০ টাকা, ১ হাজার টাকার ডিএপি ১ হাজার ৪৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। দোকানের মালিক আবুল বাসার ছিলেন না। তাঁর ফোনও বন্ধ ছিল।
পাশের আরেকটি বালাইনাশকের দোকানে বাংলা টিএসপি ২ হাজার ২০০ ও মরক্কোর টিএসপি ১ হাজার ৪৫০ টাকা বিক্রি হতে দেখা যায়। দোকানের মালিক সারোয়ার জানান, তাঁরা পুঠিয়ার নওয়াপাড়া বাজারের সাবডিলার সামাদ ট্রেডার্স থেকে বেশি দামে কিনে বিক্রি করেন। সামাদ ট্রেডার্সেও এসব সার বিক্রি হতে দেখা গেল। মালিক ছিলেন না। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে বলেন, তিনি বাইরে থেকে সার অন্যভাবে নিয়ে এসে বিক্রি করছেন। অন্যভাবে মানে কীভাবে জানতে চাইলে তিনি মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন ।
ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাগমারার তাহেরপুর থেকে পুঠিয়া সদরের কীটনাশক দোকানি আবুল হোসেনের দোকানে দুটি রিকশায় করে সার নিতে দেখা যায়। অনুসরণ করে দোকানে গেলে মালিক আবুল হোসেন বলেন, নির্দিষ্ট কোনো উৎস নয়; ১০ টাকা কম পাওয়ার জন্য কখনো নাটোরের সিংড়া, কখনো কুষ্টিয়া থেকেও সার এনে বিক্রি করেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা গণমাধ্যম কে বলেন, রাজশাহীর কোথাও সারের সংকট নেই। সরকার নির্ধারিত দামেই কৃষক সার পাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তাঁদের কড়া তদারকি আছে। বরাদ্দবহির্ভূত সার জেলায় ঢুকলেও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা আগমনী বার্তা নিয়ে বিক্রি তদারকি করেন।
কী করে যে এবার ধান চাষ করবানি ?
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার চাপাকোনা গ্রামের এক কৃষক দু:খ প্রকাশ করে বলেন, এবার আমার সাড়ে তিন বিঘা (৪২ শতকে বিঘা) জমিতে বোরো আবাদ করবেন বলে ঠিক করেছেন। তাঁর দেড় বিঘা জমি চাষাবাদের উপযোগী হয়েছে। ওই জমির জন্য তিনি ১ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়ে এক বস্তা টিএসপি এবং ১ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে এক বস্তা এমওপি সার কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সার কয়েক দিন আগে কেনা। আরও সার কিনতে হবে। এখন টিএসপি প্রতি বস্তা ২ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ডিএপি ও এমওপির দামও বেশি। কী করে যে এবার ধান চাষ করবানি।’
এ সব অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন এর মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলায় এই মুহূর্তে টিএসপির কোনো সংকট নেই। তবে মজুত কম। তাঁরা কৃষকদের টিএসপি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছেন। টিএসপির বদলে ডিএপি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছেন। বেশি দামে সার বিক্রির কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।