নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চলমান বিশেষ পরিস্থিতিতে ট্রাক সংকটের কারণে পণ্য পরিবহনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানী থেকে জরুরিভিত্তিতে খাদ্যপণ্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানো যাচ্ছে না। একইভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও খাদ্যপণ্য রাজধানীতে আনা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে রাজধানীসহ সারাদেশে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। নিরাপত্তার স্বার্থে চালক ও হেলপাররা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হতে চাইছেন না। আর মালিকরা ভয় পাচ্ছেন লোকসানের।
মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চলমান পরিস্থিতিতে অনেক চালক ও হেলপার বাড়ি চলে গেছেন। যারা আছেন, তারাও নিরাপত্তার কারণে রাস্তায় নামতে চাইছেন না। এছাড়া, দেশব্যাপী খাবার হোটেল বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘপথে ট্রাকের চালক ও হেলপারের খাবারের প্রয়োজন হয়। তারা রাস্তায় খাবার পাচ্ছেন না। অপরদিকে গাড়ি রাস্তায় অকেজো হয়ে পড়লে মেরামতেরও ব্যবস্থা নেই। কারণ, দেশের সব ওয়ার্কশপ বা গ্যারেজ বন্ধ রয়েছে। তাই এ অবস্থায় ট্রাক রাস্তায় নামানোর ভরসা পাচ্ছেন না তারা।
তারা আরও বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পণ্য পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত পণ্যও পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো ঢাকা থেকে পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাক গেলো। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পথে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য পণ্য নেই। একইভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানীতে পণ্য পৌঁছে দিয়ে ট্রাকগুলোকে খালি ফিরে যেতে হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়ছেন মালিকরা। তাই তারা এমন সিঙ্গেল ট্রিপে রাজি হচ্ছেন না।
ব্যবসায়ীরাও প্রায় অভিন্ন কথা বলছেন। বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘চালের অভাব নেই। কিন্তু করোনার কারণে ট্রাকের অভাবে নওগাঁ ও কুষ্টিয়া থেকে চাল আসতে পারছে না। তাই এই মুহূর্তে রাজধানীতে চাল সরবরাহে কিছুটা সমস্যা হওয়ায় বাজারে চালের দাম বেড়েছে।’ পরিবহন সমস্যার সমাধান না হলে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা কঠিন হবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘রাজধানী থেকে কোনও ট্রাক আসছে না। তাই পর্যাপ্ত চাল মজুত থাকার পরেও রাজধানীতে পাঠাতে পারছি না।’ তার আশঙ্কা, অবিলম্বে এর সমাধান করা না গেলে চাল সরবরাহ ঠিক রাখা কঠিন হবে।
দেশের খ্যাতনামা নিত্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘নানা কারণেই পরিবহন সংকট রয়েছে। আর এ কারণে আমাদেরও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য পৌঁছে দেওয়া কঠিন হচ্ছে। তারপরও আমরা সব ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘রাস্তায় গ্যারেজ বন্ধ। খাবার হোটেল বন্ধ থাকাসহ নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এসব কারণে চালক ও হেলপাররাও ঘরের বাইরে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন।’
রাজধানীর ট্রাক ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান বলেন, পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলেই ট্রাক চলছে না। তিনি বলেন, ‘ধরুন, রাজধানী থেকে একটি ট্রাক পণ্যবোঝাই করে চট্টগ্রাম বা বরিশাল পাঠালাম। গন্তব্যে পণ্য পৌঁছে দিয়ে ট্রাকটিকে ফেরার পথে খালি আসতে হয়। কারণ, ফেরার পথে রাজধানীতে নিয়ে আসার জন্য পণ্য পাওয়া যায় না। অথচ যাওয়া-আসার পথে ফেরির টোল, ব্রিজের টোলসহ নানা খরচ রয়েছে। এর ওপর পুলিশের হয়রানি তো রয়েছেই।’ লোকসান ও হয়রানি থেকে বাঁচতে ট্রাক গ্যারেজে রেখে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরিফুর রহমান বলেন, ‘এছাড়া চালক ও হেলপাররা তো সরকারের ঘোষণা শুনেই বাড়ি চলে গেছেন। কবে আসবেন, কে জানে। এমন অবস্থায় ট্রাক কে চালাবে?’
বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন বলেন, ‘মৃত্যুভয় সবারই রয়েছে। পরিবহন বন্ধের ঘোষণা পেয়েই শ্রমিকরা বাড়ি চলে গেছেন। তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই রাজধানীতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাক সংকট দেখা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, বিআরটিসির অনেক ট্রাক রয়েছে। এসব ট্রাকের চালকরা সরকারি কর্মচারী, তাই তাদের পাওয়া সহজ। বিআরটিসির ট্রাকগুলো রাস্তায় নামানো গেলে জরুরি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন অনেকটাই সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ট্রাক শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে রাস্তায় নিরাপত্তা নেই। গ্যারেজ খোলা নেই। খাবার হোটেল বন্ধ। রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হলে সারাবো কোথায়? এর ওপর পুলিশের নানা রকমের হয়রানি রয়েছে। এসব কারণে আমরা গাড়ি চালাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘মালিকরা সিঙ্গেল ট্রিপে ট্রাক ছাড়েন না। এতে তারা লোকসানে পড়বেন। এর ওপর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় তো রয়েছেই। নানা কারণেই রাস্তায় পণ্যবাহী ট্রাকের সংকট দেখা দিয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘যেকোনও পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী খাদ্যপণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর। এর জন্য যা যা করার প্রয়োজন, সরকার তাই করবে। এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। প্রয়োজন হলে বিআরটিসির ট্রাকসহ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা হবে।’