গণপূর্তের ‘বিতর্কিত’ প্রকৌশলীদের দিকে দুদকের নজর : তালিকায় আছেন  তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী এবং নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব গং

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা প্রশাসনিক সংবাদ বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

# ফ্ল্যাট-প্লট-বালিশ কাণ্ডের প্রকৌশলীরা এখনো বহাল তবিয়তে # দুদকের অনুসন্ধানকারী টিম গঠন # দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেই ব্যবস্থা —–আদিলুর রহমান খান  # 


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক  : গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের সব মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে দুর্নীতি আর অনিয়মের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত ৫ আগস্টের আগে এসব দুর্নীতির খবর অনেকটা চাপা পড়ে ছিল। দু-একটি দুর্নীতির খবর শোনা গেলেও তা তদন্তের নামে আসল খবর জানা যায়নি। এখন পরিবর্তিত সময়ে হরহামেশাই বিগত সরকারের আমলের নানা দুর্নীতি-অনিয়মের খবর জানা যাচ্ছে। নানা তদন্তে বের হয়ে আসছে দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের খবর। তেমনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তর।


বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, সরকারি যতগুলো প্রতিষ্ঠান-মন্ত্রণালয় গত ১৫ বছর ধরে দুর্নীতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে তারমধ্যে গণপূর্তের নাম সবার সামনে থাকবে। এই মন্ত্রণালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির খবরের পাশাপাশি সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে টাকা পাচারের তথ্যও জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন

তাই গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ চক্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, বিগত সরকারের সময় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। দুদকের অনুসন্ধানে অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান প্রকৌশলীদের বিপুল সম্পদের তথ্য মিলেছে বলেও জানা যায়।


বিজ্ঞাপন

দুদকের নির্ভরযোগ্য সুত্রের দাবি :  এদিকে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে এক ডজনেরও বেশি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুদকের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এবার প্রভাব কাজে না লাগলে গণপূর্তের অনেক রাঘববোয়াল আইনের ফাঁদে পড়বেন। ইতোমধ্যে সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে সংস্থাটি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে প্রায় ১২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ ৭ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক এই মন্ত্রী ও তার স্ত্রী ফিরোজাা পারভীনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুদক।

দুদকের  বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা থেকে জানা যায়  : অন্যদিকে দুদকের বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে তারা সবাই বিগত সরকারের সময় গড়ে ওঠা আলোচিত টেন্ডার সিন্ডিকেটের সদস্য। তারা হলেন- জিকে শামীম, গোল্ডেন মনির ও সাজিন এন্টারপ্রাইজের শাহাদাত হোসেনসহ আরও অনেকে। এরা সবাই দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন: সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও শাহাদাত হোসেন, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন ও ড. মঈনুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক মধু, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসু, নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত উল্লাহ, ইলিয়াস আহমেদ,  সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান এবং নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব।

রফিকুল ইসলাম বালিশকান্ডের প্রাক্কলন তৈরির জন্য আজও বিখ্যাত :  অন্যদিকে রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বালিশকাণ্ডের প্রাক্কলন তৈরিতে অস্বাভাবিক দর নির্ধারণ করেন। তার ছেলের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেন। শাহাদাত হোসেনও একইভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়েছেন।

মোসলেহ উদ্দিনকে পরিচিত ‘মিস্টার ১৫ পার্সেন্ট’ নামে : মোসলেহ উদ্দিনকে পরিচিত ‘মিস্টার ১৫ পার্সেন্ট’ নামে। বর্তমানে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে কর্মরত এই কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইয়ে অর্থপাচার করেছেন বলে দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে। বিভিন্ন ঠিকাদারের সঙ্গে তার গোপন চুক্তির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে, ড. মঈনুল ইসলাম সরকারি চাকরিতে অনুপস্থিত থেকে বিদেশে থেকে ফিরে পুনরায় চাকরিতে বহাল হন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার ও নামে-বেনামে শত শত একর জমির মালিক হওয়ার অভিযোগ আছে।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী ১৬ বছর ঢাকায়  :  তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী ১৬ বছর ঢাকায় থেকে প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। প্রদীপ কুমার বসু দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েছেন। রোকনউদ্দিন অস্ট্রেলিয়ায় পলাতক অবস্থায় স্ত্রীর নামে ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ ছাড়া অন্য অভিযুক্তদের মধ্যে ফজলুল হক (মধু), ইলিয়াস আহমেদ ও মুমিতুর রহমান আছেন, যারা সরকারি প্রকল্পে কাজ না করেই বিল পরিশোধ, টেন্ডার সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী গণমাধ্যমকে জানান, সরকারি অফিসগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক যাচাই শেষে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জানা গেছে, দুদকের এ অনুসন্ধানকারী টিমে রয়েছেন পরিচালক আব্দুল মাজেদ, উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার, সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ভূঁইয়া ও উপসহকারী পরিচালক এলমান আহাম্মদ অনি। অনুসন্ধান টিমের সদস্যদের রদবদল হলেও সংস্থাটি দ্রুত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে।

জিকে শামীমের সহযোগীরা এখনো গণপূর্তের সিন্ডিকেট  : অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরে যেই জিকে শামীম সিন্ডিকেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে, সেই সিন্ডিকেট আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ৫ আগস্টের পর সেই চক্রকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হলেও নানা তদবির-বাণিজ্যে তারা আবার ঢাকায় চলে আসছেন বলে জানা গেছে।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ বিশেষ স্থাপনাসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম। এর আগে ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ই/এম বিভাগ- ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে। নানান দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে আওয়ামী লীগের আমলে বদলি করা হয় রাজশাহী ডিভিশন। সেখানে নিয়মিত অফিস না করেই বেতন নিতেন জাহাঙ্গীর। আবার ঢাকায় ফিরতে নানান স্থান দিয়ে তদবির করার খবর পাওয়া গেছে। মাত্র ৮ মাসের মাথায় ফিরে এসেছেন তার কমিশন খ্যাত ঢাকায়।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী ঠিকাদার এবং ক্যাসিনোকান্ডের জিকে শামীম।

 

কে এই জিকে শামীম  : যুবলীগের সমবায় সম্পাদক হিসেবে পরিচয়দানকারী জি কে শামীমের পূর্ণ নাম এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম। নারায়ণগঞ্জ শাখা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও তিনি। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদক ছিলেন। জি কে শামীম বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেও জানা গেছে। প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার সরকারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজ তার নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে গণপূর্ত বিভাগে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র পর্যন্ত শামীমের ঠিকাদারির হাত বিস্তৃত।

যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে জি কে শামীম পরিচয় দিলেও উভয় সংগঠন অবশ্য তা অস্বীকার করেছে। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র‍্যাব। এ সময় ওই ভবন থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে টেন্ডারবাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম নির্বাহী প্রকৗশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম। তার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

জানা গেছে, গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৗশলী মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। মাত্র ৯ বছর গণপূর্তে চাকরি করে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিসহ অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ রয়েছে।

আলোচিত আরেক প্রকৌশলী মো. ফজলুল হক (মধু)  :  গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়নাধীন আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল প্রদান করা হয়েছে জেলহাজতে থাকা এসএম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে। এ ব্যাপারে চিঠিও দেওয়া হয়েছে তাকে। কিন্তু তারপরও গণপূর্তের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবৈধভাবে অতিরিক্ত বিল প্রদানের জন্য দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি।

তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা বা তদন্ত কমিটিও গঠন করেননি। এমনকি শোকজ পর্যন্ত করেননি। বরং অযৌক্তিক কমিটি গঠন ও চিঠি চালাচালির মাধ্যমে সময় ক্ষেপণ এবং গুরুতর অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই কর্মকর্তা আলোচনায় আসেন। ফেঁসেও যান তিনি, বেরিয়ে আসে জিকে শামীমের সঙ্গে তার সখ্যতার নানা তথ্য। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিষয়ে তদন্তও করে।

ফজলুল হক (মধু) তৎকালীন সময়ে গণপূর্তের শেরে বাংলা নগর-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকলেও বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) তিনি। সম্প্রতি তাকে পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নও করা হয়েছে।

এসব অভিযোগ নিয়ে কথা হলে ফজলুল হক (মধু) বলেন, ‘তখন আমি কি কারণে ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল দিয়েছিলাম সেটা নিয়ে অনেক কথা আছে। তবে তা নিয়ে এক প্রকার মীমাংসা হয়ে গেছে। এটা নিয়ে কথা না বলাই ভালো।’

এদিকে জানা গেছে, কাজ সম্পন্ন করার আগেই আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমকে অবৈধভাবে অগ্রিম ১০ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করার ঘটনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী, শেরে বাংলা নগর-১ এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে রাজশাহীতে চলতি দায়িত্বে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত) মোহাম্মদ ফজলুল হককে বেতন গ্রেড কমানোর শাস্তি দিয়ে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন অভিযুক্ত প্রকৌশলীকে বর্তমান বেতন গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপে নামিয়ে দেওয়ার বিষয়ে গত ২৫ জানুয়ারি এক অফিস আদেশ জারি করেন।

তবে জানা গেছে, ফজলুল হক (মধু) রাজশাহীতে গিয়ে থেমে নেই। সেখানে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। ঢাকায় রেখে যাওয়া ঠিকাদারদেরও শেল্টার দিচ্ছেন তিনি। সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভাগিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকার কাজ।

গণপূর্ত অধিদপ্তর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (বি ২০০৫) তথাকথিত সভাপতি রেজাউল করিম রেজা একটি আতঙ্কের নাম :  আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকালে সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করেছে সে। বর্তমানেও তার দাপট এবং ক্ষমতা আকাশচুম্বী বলে জানা গেছে। একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, অধিদপ্তরের সকল কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি হয়েছে রেজা সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট নানাবিধ কাজ করে, এর মধ্যে রয়েছে চেক জালিয়াতি, প্রতারণার মাধ্যমে চাকরি নেওয়া ও দেওয়া, ঘুষের মাধ্যমে পদোন্নতি, গণপূর্তের বাসা বরাদ্দ দেওয়ার নামে ঘুষ গ্রহণ, বরাদ্দকৃত বাসা বহিরাগতদের ভাড়া দিয়ে বানিজ্য, আর বদলি বাণিজ্যতো আছেই। তিনি সরকারি চাকরি করা সত্ত্বেও ঠিকাদারি লাইসেন্স করে ঠিকাদারি বাণিজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানা যায়।

দুদক রেজার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল হলে কমিশন গত বছরের ১১ জুলাই  ( স্মারক নং- ১৬৮৪ ) একটি চিঠি প্রেরণ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর বরাবর। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় মোহাম্মদ রেজাউল করিম বাংলাদেশ গণপূর্ত অধিদপ্তর শ্রমিক কর্চারী ইউনিয়ন, ঢাকা, এর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে পত্র এবং প্রমাণাদি চায় সংস্থাটি।

এদিকে পতিত সরকারের আমালে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অনিয়ম-দুর্নীতির সামনের সারিতে ছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব। হাসিনা সরকারের আমলের যে কজন প্রভাবশালী পূর্ত প্রকৌশলী জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে আহসান হাবিব তাদের অন্যতম বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য পরিচয় দেওয়া আহসান হাবিব হাসিনা সরকারের সময় ঢাকা পোস্টিংয়ের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়ে সাভার ও নারায়ণগঞ্জে ঘুরতে থাকেন। তবে ভাগ্য পাল্টে যায় হাসিনার পতনের পর। নানা তদবির দেন- দরবার করে ঢাকা আসেন। আহসান হাবীব গণপূর্ত বিভাগ নারায়ণগঞ্জে যোগদান করেন ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর আর ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর তাকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ -১ বদলি করা হয়। যদিও এর আগেও তিনি ঢাকায় মেডিকেল বিভাগে ছিলেন তখন নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তাকে সাভার বদলি করা হয়।

হত্যা মামালার আসামি, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তবুও ঢাকায় পোস্টিং এসব নিয় বেশ গুঞ্জন চলছে খোদ দপ্তরেই। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করছে, আহসান হাবীব আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঢাকায় নির্বাহী প্রকৌশলীদের যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠে তার অন্যতম সদস্য। দুর্নীতি আর অনিয়মের মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকার একাধিক এলাকায় রয়েছে প্লট-ফ্ল্যাটও। এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য আহসান হাবিবকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি বিধায় তার কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশিত হলো না।

ঢাকা কলেজের সাবেক  ছাত্রলীগ নেতা এবং  স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারের ভাগ্নে ও  গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী ঠিকাদার।

 

ঢাকা কলেজের সাবেক  ছাত্রলীগ নেতা এবং  স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারের ভাগ্নে ও  গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী ঠিকাদার :  গত বছরের ১৬ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হেলমেট পরা পিস্তল হাতে থাকা যুবকের পরিচয় মিলিছে, তিনি আর কেউ নন, তিনি গণপূর্তের ঠিকাদার হাসান মোল্লা। ঢাকা কলেজের সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারের ভাগনে। এছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় ও মিলেছে তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী ঠিকাদার এবং ঢাকা কলেজের সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারের ভাগ্নে। মামা আবু কাউছারের বদান্যতায় আর অর্থ পাচার মামলায় কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ছত্রছায়ায় ঠিকাদারি শুরু করেন হাসান। ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে ছিল গত বছরের ১৬ জুলাই। চারদিকে শুধু গুলি-গ্রেনেডের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেই বর্বরতা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হেলমেট পরা অবস্থায় পিস্তল হাতে গুলি চালাতে দেখা যায় এক যুবককে। এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। অবশেষে পরিচয় মিলেছে তাঁর। তিনি গণপূর্তের ঠিকাদার হাসান মোল্লা। ঢাকা কলেজের সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারের ভাগ্নে । গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবু কাউছার একসময় জি কে শামীমের মাধ্যমে গণপূর্তের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। বড় অঙ্কের কাজ করত জি কে বিল্ডার্স লিমিটেড ও দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স। আর ১০ কোটি টাকার নিচের কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করত হাসানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মা-বাবার দোয়া কনস্ট্রাকশন। মামা ও বড় ভাইদের সহায়তায় গণপূর্ত ঢাকা বিভাগ-৪-এর ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়েছেন হাসান।

দুদকের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জি কে শামীমের ‘সহযোগী’ গণপূর্তের ১১ প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। তাদের বিরুদ্ধে যুবলীগের কথিত নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীমকে (জি কে শামীম) সহযোগিতার অভিযোগও খতিয়ে দেখবে সংস্থাটি। দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সেই তালিকায় ছিলেন- অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন ও আবদুল মোমেন চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মো. ফজলুল হক, আবদুল কাদের চৌধুরী, আফসার উদ্দিন, মো. ইলিয়াস আহমেদ ও ফজলুল হক মধু এবং গণপূর্ত সার্কেল-৪-এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্তের একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে তারা অনেক দুর্নীতি-অনিয়ম করেছেন। নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এদের ক্ষমতার উৎস কি? তা ভবনের সবারই অজানা নয়। আমরা চাই দুর্নীতি করে যত সম্পদ অর্জন করেছেন তা বাজেয়াপ্ত করা হোক। তাদের আইনের আওতায় দ্রুত বিচার হোক।

এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘যারা অতীতে দুর্নীতি করেছেন তাদের তালিকা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজও শুরু হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

গণপূর্তে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে এক ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘ইতোমধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দুদকের টিম খতিয়ে দেখছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দুদক সেই প্রতিষ্ঠান বা অধিদপ্তরগুলোতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাই সুনির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতির খবর আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমেও জানতে চাই। এতে আমরা কাজ করতে আরও সুবিধা হবে। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো খাত কিংবা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবরকে দুদক খুব গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে।’

এদিকে একটি মামলায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ২৭ মার্চ জি কে শামীমকে সাড়ে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ওই মামলায় তার মাকে খালাস দেওয়া হয়। অবৈধ ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত এ ঠিকাদারকে পাঁচ বছর ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দণ্ডের পাশাপাশি তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও তিন মাস বিনাশ্রম কারাভোগ করতে হবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া জি কে শামীমের ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তার মা আয়েশা আক্তারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর জি কে শামীম ও তার মা আয়েশা আক্তারের বিরুদ্ধে ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এদিকে এক সূত্র জানায়, সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বালিশকাণ্ডে জড়িত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত মূল্যে কাজ পাইয়ে দেন। তিনি পরে তদন্ত প্রতিবেদন গায়েব করে রাঘববোয়ালদের বাঁচান। রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ থেকে পরিবারের সদস্যদের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে বিক্রি করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *