সোনালী ব্যাংকে বিএনপির চক্রবদ্ধ সিন্ডিকেটে আওয়ামী লীগ দোসদের স্থান

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত কর্পোরেট সংবাদ গ্রাম বাংলার খবর জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন রাজনীতি রাজশাহী সংগঠন সংবাদ সারাদেশ

রাজশাহী প্রতিনিধি  : রাজশাহীর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পিএলসিতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে আওয়ামী দোসরদের একাধিক চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী। গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক সরকার পতনের পর দেশজুড়ে এক ধরনের আশার আবহ তৈরি হলেও, রাজশাহীর সোনালী ব্যাংকে সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া পৌঁছায়নি। বরং, নতুন মুখোশে পুরনো সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে—এই সিন্ডিকেট চক্রের মূল হোতা হচ্ছেন আওয়ামী ঘনিষ্ঠ মো. আব্দুল আউয়াল ও বিএনপি ঘনিষ্ঠ মো. জাকির হোসেন।


বিজ্ঞাপন

রবিবার (২২ জুন) ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, সিবিএ-২০২ এর সহ-সভাপতি ও বিতর্কিত নেতা মো. আব্দুল আউয়ালকে আবারও রাজশাহী জোনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সিবিএ-৬৬৪ এর কেন্দ্রীয় সভাপতি জাকির হোসেন ঢাকা থেকে একটি দল নিয়ে রাজশাহীতে আগমন করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল—জেনারেল ম্যানেজার খোকন চন্দ্র বিশ্বাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বদলির আদেশ কার্যকর করানো।


বিজ্ঞাপন

অভিযোগ রয়েছে, এই তৎপরতার পেছনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন এবং উচ্চপর্যায়ের প্রভাব বিস্তার। বিশ্বস্ত কর্মকর্তারা জানান, খোকন চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকে বসে তারা “রিকোয়েস্ট অর্ডার” জমা দিয়ে সরাসরি বদলির চাপ প্রয়োগ করেন।


বিজ্ঞাপন

তবে এটাই প্রথম নয়—সিবিএ-৬৬৪-এর সভাপতি জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে এর আগেও চাঁদাবাজির একাধিক মামলা রয়েছে। তিনি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার স্টাফদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন। এই তথ্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথিপত্রেও স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন—একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কীভাবে এখনও কেন্দ্রীয় সভাপতির আসনে বহাল থাকেন?


বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, জাকির হোসেনের চাঁদাবাজি কৌশল অনেকটাই সংগঠনের নামে চাঁদা তোলা। ব্যাংকের বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণ ইস্যুতে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন তিনি। এসব অভিযোগ ব্যাংকের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একাধিকবার লিখিতভাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, কিন্তু সিন্ডিকেটের প্রভাবের কারণে অভিযোগগুলো মুলতবিতেই থেকে যায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিন্ডিকেট শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি এক ধরনের ক্রিমিনাল পলিটিকাল নেটওয়ার্ক। এখানে রাজনীতির ব্যানারে ঘটা করে চাঁদাবাজি চলে, বদলি-বাণিজ্য চলে। আউয়াল-মুজাহার-জাকির হোসেনদের মতো লোকেরা ব্যাংকের মত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে নিজ নিজ অপরাধমূলক স্বার্থ পূরণ করে চলেছে।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী অঞ্চলে চলমান ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে সশস্ত্র আক্রমণের নেতৃত্ব দেন এই আব্দুল আউয়াল ও মুজাহার আলী। হামলায় গুরুতর আহত হয় ছাত্র ও জনতা। সেই অপরাধের জন্যই তাদের পরে পাবনায় বদলি করা হয়। অথচ, এখন জাকির হোসেন তাদের ফের রাজশাহীতে ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একে “চক্রবদ্ধ অপরাধমূলক সিন্ডিকেটের পুনর্জাগরণ” হিসেবে অভিহিত করছেন।

এই সিন্ডিকেটের আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো—বদলি বাণিজ্য। নিরপেক্ষ কর্মকর্তা যারা সিন্ডিকেটের বাইরে থাকেন, তাদের বদলি করে দূরবর্তী ও নিম্নক্ষমতা সম্পন্ন শাখায় পাঠানো হয়। বিশেষ করে যারা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সমর্থন জানিয়েছিলেন বা ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদেরকে নানা কৌশলে হয়রানি করা হচ্ছে।

সোমবার (২৩ জুন) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা ভাবছিলাম, বদলির নামে প্রতিশোধপরায়ণতা বন্ধ হবে। কিন্তু এখন আবারও দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দালালরা নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে টাকা ছড়াচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে।”

অন্যদিকে, সিন্ডিকেট সদস্যদের পরিচয়ও চমকে দেয়ার মতো। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি এএইচ মাহমুদুন্নবী, উপদেষ্টা কামরুজ্জামান, সহ-সভাপতি জয়ন্ত কুমার সরকারসহ আরও অনেকেই প্রিন্সিপাল অফিস ও জিএম অফিসে কর্মরত থেকেও সিন্ডিকেটের ছায়া বিস্তার করছেন। এরা প্রত্যেকে প্রভাব খাটিয়ে পছন্দের লোক বসাচ্ছেন, অপছন্দেরদের সরাচ্ছেন, এবং নিজস্ব দলে চাঁদা সংগ্রহের দালাল নিয়োগ দিচ্ছেন।

সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়ীজ এসোসিয়েশনের নেতাদের একাংশও এই সিন্ডিকেটে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। শাহে আলম, হাবিবুর রহমানসহ একাধিক নেতা আউয়ালকে ফিরিয়ে আনতে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, রাজনৈতিক চাপ ও অর্থের লেনদেনে যুক্ত বলে দাবি করছেন জিয়া পরিষদের নেতারা।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) এই প্রসঙ্গে জিএম খোকন চন্দ্র বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, “আদেশ দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। তবে কিছু লোক চাপ দিচ্ছে। আমরা আদেশ না দিয়ে বিষয়টি আটকে রেখেছি।”

সোনালী ব্যাংকের এজিএমের কক্ষে প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সিবিএ সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. জাকির হোসেনের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকা দুজন এজিএমকে বদলী আদেশ সম্পন্ন করতে জোর করার দৃশ্য ফুটে ওঠে।

এবিষয়ে সিবিএ সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. জাকির হোসেন জানান, তাঁরা রাজশাহীতে কর্মচারী সমাবেশ করতে এসেছেন। বদলী সংক্রান্ত বিষয় গোপনীয় হওয়ায় তিনি সন্ধ্যার পর যেখানে উঠেছেন সেখানে সাক্ষাৎ করতে বলেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, “এই পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের নিরাপত্তা এবং জনআস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি। যে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে সিন্ডিকেট চালানো মানে জনগণের সম্পদকে জিম্মি করা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মন্ত্রণালয়ের উচিত অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করা।”

সোনালী ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি চাঁদাবাজ ও দোষী ব্যক্তিদের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটাই হবে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *