নিজস্ব প্রতিনিধি (সিলেট) : সিলেটের সাতটি ও বান্দরবানের ১০টি পাথরমহালে (পাথর কোয়ারি) পরিবেশবান্ধব টেকসই ইকো ট্যুরিজম ব্যবস্থাপনায় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে হাইকোর্ট বিভাগ নির্দেশ দিয়েছেন।

পাথর মহাল গুলো হচ্ছে, সিলেট জেলার জাফলং, শাহ আরেফিন টিলা, ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, শ্রীপুর, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া এবং বান্দরবান জেলার ১০টি ঝিরি—ছড়া পাথরমহাল।
পাশাপাশি আদালত সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে আদালতে স্বশরীরে হাজির হয়ে ২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি সিলেটের পাথরমহালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ৩ মাসের মধ্যে উপরোক্ত আদেশসমূহ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কর্তৃক দায়েরকৃত একটি জনস্বার্থমূলক মামলার (নং ১৩৪৮৫/২০২৫) প্রাথমিক শুনানী শেষে বিচারপতি কাজী জিনাত হক এবং বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দীকা এঁর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেন।

বেলার পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট এস হাসানুল বান্না। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহা. এরশাদুল বারী খন্দকার।
রবিবার (২৪ আগস্ট) বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। বেলা সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাদেহা আক্তার উচ্চ আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বেলা সূত্র জানায়, এসব এলাকায় ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনকভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ বন্ধে বিবাদীগণের ব্যর্থতা ও নিস্ক্রিয়তা সংবিধান এবং দেশে প্রচলিত আইন ও বিচারিক সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন বিধায় কেন তা কর্তৃত্ববিহীন, অবৈধ ও জনস্বার্থবিরোধী ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে অবহেলার কারণে কেন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে বিবাদীগণের ওপর রুল জারি করেছেন মহামান্য আদালত।
জারিকৃত এ রুলে উল্লেখিত পাথর কোয়ারিগুলোকে কেন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা এবং পরিবেশবান্ধব টেকসই ইকো—ট্যুরিজম হিসেবে রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার নির্দেশ প্রদান করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। অননুমোদিত ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের, পাথর উত্তোলনের ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণের এবং প্রকৃত দোষীদের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ প্রদান করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।
রুল জারির পাশাপাশি মহামান্য আদালত উল্লেখিত পাথরমহাল গুলো থেকে ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক পাথর উত্তোলন, সংগ্রহ ও অপসারণের কার্যক্রম যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে বিবাদীগণকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
একইসঙ্গে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সিলেট ও বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসককে পরিবেশবান্ধব টেকসই ইকো—ট্যুরিজম বিকাশের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা এবং বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে গত ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পাথরমহাল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা আগামী ৩ (তিন) মাসের মধ্যে প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেছেন ।
আদালত সিলেট জেলার উল্লেখিত ৭টি পাথরমহালসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনকভাবে পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত ও প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রস্তুত ও আদালতে দাখিলের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক, সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন। আদালত সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে আদালতে স্বশরীরে হাজির হয়ে ২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি সিলেটের পাথরমহালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ৩ (তিন) মাসের মধ্যে উপরোক্ত আদেশসমূহ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বেলার পর্যবেক্ষণ থেকে বলা হয়, ২০১৩ সালে সমগ্র দেশের মোট ৫১টি এলাকাকে সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ পাথর/বালুমিশ্রিত পাথর সমৃদ্ধ এলাকা ঘোষণা করে।
পাথর কোয়ারিগুলোর অবস্থান সিলেট, সুনামগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও বান্দরবান জেলাসমূহে। পাথর উত্তোলনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় ২০২০ সালে দেশের সকল পাথরমহাল থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
পরবর্তীতে ২০২৫ সালে পাথর উত্তোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করলে সিলেটের উল্লেখিত মহাল ও মহাল বহিভূর্ত বিভিন্ন স্থান থেকে ধ্বংসাত্মকভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ নির্বিচারে চলতে থাকে। যা দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়। এ অবস্থায় গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ১) জাফলং, মামলাভুক্ত শাহ—আরেফিন টিলা ও বান্দবান পার্বত্য জেলার পাহাড়ি ঝিরি—ছড়া এলাকার ১০টিসহ মোট ১২ পাথরমহালের পরিবেশগত বিধিনিষেধ থাকায় ইজারা কার্যক্রমের আওতা বহির্ভূত থাকবে; ২) সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া; জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর; গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন বিছনাকান্দি এবং কানাইঘাট উপজেলাধীন লোভাছড়া পাথর কোয়ারিসমূহের ইজারা কার্যক্রম আপাতত স্থগিত থাকবে; ৩) অবশিষ্ট পাথর কোয়ারিসমূহ ইজারা প্রদানের পূর্বে পরিবেশের ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে; ৪) পাথর কোয়ারিসমূহ হতে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সাথে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরচিালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
কেবলমাত্র পাথর শ্রমিক ও পরিবহন ড্রাইভার নয়, অবৈধ/অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সাথে জড়িত এদের পৃষ্ঠপোষক/মূল হোতাদেরকে চিহ্নিত করে গ্রেফতারপূর্বক আইনের আওতায় আনতে হবে; ৫) অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্ট স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এসকল চেকপোস্ট/টাস্কফোর্স অভিযানের মাধ্যমে অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর পরিবহনকারী ট্রাক আটক করার উপর জোর দিতে হবে; ৬) পাথর কোয়ারিসমূহ থেকে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে উত্তোলিত পাথর জব্দ করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; ৭) পাথর কোয়ারিসমূহ থেকে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহারণ ও অপসারণের বিষয়ে জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট/টাস্কফোর্স অভিযান সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য—উপাত্ত সম্বলিত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রেরণ করতে হবে; ৮) বিজ্ঞ আদালতের আদেশে বন্ধ থাকা পাথর কোয়ারিসমূহে যথাযথভাবে আদালতের আদেশ প্রতিপালন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং ৯) সিলেটের পাথর কোয়ারি সংলগ্ন এলাকার পর্যটন শিল্পের বিকাশে জেলা প্রশাসন কর্তৃক একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
আইন, আদালতের আদেশ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধন্তের ব্যতয় ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ অব্যাহত থাকলে তা বন্ধে বেলা উল্লেখিত মামলা দায়ের করে।
মামলার বিবাদীগণ হলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রণালয় (জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিভাগ); পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (জন নিরাপত্তা বিভাগ); বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব; পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক; খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক; সিলেট জেলার বিভাগীয় কমিশনার; সিলেট ও বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।