হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল ভারতের নকশায় নির্মিত  : জবানবন্দিতে বদরুদ্দীন উমর  

Uncategorized অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা প্রশাসনিক সংবাদ বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী রাজনীতি সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  হাসিনার শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভারতের নকশায় নির্মিত ছিল বলে উল্লেখ করেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি বলেছেন, তার সরকারের শাসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল।


বিজ্ঞাপন

জুলাই বিপ্লবে গণহত্যা চালানো ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে এসব কথা বলেন লেখক, গবেষক ও

বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর। গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন এ তথ্য জানান।


বিজ্ঞাপন

আমি বদরুদ্দীন উমর। পিতা মরহুম আবুল হাশিম। আমার স্থায়ী ঠিকানাÑবাড়ি নম্বর ৬০, রোড নম্বর ২০, রূপনগর আবাসিক এলাকা, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।


বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি ‘গণঅভ্যুত্থানের দেশ’Ñ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনাগুলো তার উদাহরণ। তবে এসব অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের (১৯৫২) মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল, ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল, ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন, এমন পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। শুধু হাসিনাই নয়; তার মন্ত্রিসভা, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও দেশ ছেড়ে পালায়। এরকম ব্যাপক দলীয় পতন, আতঙ্ক ও আত্মগোপন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশে স্বৈরাচার পতনের পরও এত সংগঠিত দলীয় পলায়ন দেখা যায়নি।

এই অভ্যুত্থানের গভীরতা বোঝাতে একটি প্রতীকী চিত্র যথাযথÑশেখ হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারা দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল সাধারণ মানুষ ভেঙে ফেলে। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি, তবুও এটি ঘটেছে। এটি এক ধরনের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, যার বহিঃপ্রকাশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে।

শেখ মুজিব নিজেই এক সময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সিরাজ শিকদার কোথায়?’—যেটা ছিল একটি অমানবিক ব্যঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল ওই বছরেরই আগস্টে, যখন মানুষ বলেছিলÑ‘শেখ মুজিব কোথায়?’ এভাবে ইতিহাসে অনেক সময় ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিশোধের রূপে।

এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনরুত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।

এছাড়াও এই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ছাত্রদের ভূমিকা। তারাই এই আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু এবারের আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনা বড় বড় সব অপরাধ করেছে আর শেখ হাসিনাকে ওই সময় ভারত সমর্থন দিয়ে গেছে। সে দীর্ঘদিন ভারতে থাকার সময় সেখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে তার যে গভীর সম্পর্ক ছিল, এটা কোনো নতুন ব্যাপার ছিল না। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল যে, ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেটা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে পতনের পর সে ভারতে পালিয়েছে। সে ওখানেই থাকবে। ওখানে থাকাটাই এক ধরনের শাস্তি। সেখানে সে জ্বলেপুড়ে মরবে। আরেকটি শাস্তি হতে পারে যেটা আমি মনে করিÑভারত সরকার তাকে মেরে ফেলবে নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে। তারা যতদিন তাকে রাখবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে না। আর সেই সম্পর্ক ভালো করতে গেলে তার ব্যাপারে একটি ফয়সালা করতে হবে। তাকে ওখানে রাখা যায় কি যায় না, সে প্রশ্ন না। তবে যদি মেরে ফেলে নরেন্দ্র মোদি, আশ্চর্য হবেন না। তারা এমনভাবে বিষয়টি সাজাবে যে, মনে হবে বাংলাদেশি কেউ তাকে মেরেছে। এরকম একটি সংগঠিত প্রচার চালাবে।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল নির্বাচনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনÑএগুলোর প্রতিটি সে ম্যানিপুলেট করেছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপরÑনির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র সবকিছুর ওপর সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

প্রথম থেকেই শেখ হাসিনা ঠিক করেছিল যে, নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে। সেটি করতে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা সম্ভব নয়। অথচ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিল, সংশোধনী এনেছিল। কোনো নীতিবোধ বা নৈতিক লজ্জাবোধ তার ছিল না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সেই হাসিনাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিল। কারণ সে বুঝেছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে পরবর্তীবার তারা আর জিততে পারবে না। সুতরাং নির্বাচনে জিততে হলে তাকে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে।

সে প্রশাসনকে দুভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রথমত ঘুস, টাকা-পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। দ্বিতীয়ত হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে। ২০০৯ সালের মধ্যেই এই নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো করে।

২০১৪ সালে ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতেই দেয়নি। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ হয়েছে। দিনে ভোট হলেও আসলে ভোট হয়ে গেছে আগের রাতেই। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা। এভাবে নির্বাচন করেও সে জয়লাভ করে, যদিও জনসমর্থনের কোনো ভিত্তি ছিল না। ওইসব নির্বাচনে দেখা গেছে তার দল ৩০০ সিটের মধ্যে চার-পাঁচটি সিটও পাবে কি না সন্দেহ। এরপরও সে জয়ী হয়েছে শুধুমাত্র প্রশাসনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে। এটা গোপন কিছু নয়, সবাই জানে। একটি সরকার যদি চায় তারা এভাবে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা ঠেকানো কঠিন।

নির্বাচনে শুধু কারচুপিই নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর দমন চালিয়েছে শেখ হাসিনা। কোনো রাজনৈতিক দল যাতে কার্যকরভাবে নড়াচড়া করতে না পারে, সেজন্যও নির্যাতন করা হয়েছে। প্রচুর মানুষকে গ্রেপ্তার করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে বিনা কারণে। ‘আয়নাঘর’ নামে টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছে, যেটা শেখ মুজিবের আমলেও ছিল না। শেখ মুজিব বিরোধীদের সরাসরি হত্যা করতেন; শেখ হাসিনা শুধু হত্যা করত না, নির্যাতনও করত এবং এতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেত।

সুতরাং এভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে নিজের করায়ত্ত করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেছে।

শেখ হাসিনার আমলে বিচারবহির্ভুত খুন-নির্যাতন নিয়ে যদি বলতে হয়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডÑএই ধরনের কাজ কেবল ওই ব্যক্তি করতে পারে, যার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে। যার অধীন ইন্টেলিজেন্স বিভাগ, ডিজিএফআইয়ের মতো সংস্থা থাকে। ‘আয়নাঘর’-এর মতো গোপন নির্যাতন সেল কিংবা গুমের মতো অপরাধÑএসব তো ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমেই ঘটানো হয়েছে। যতগুলো অপহরণের ঘটনা দেখা যায়, তার পেছনে ডিজিএফআইয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

এরপর তারা অন্যভাবে, যাকে বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সেগুলোও সংঘটিত করেছে। তারা এসব করেছে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার লক্ষ্যে। বিএনপিকে তারা ধীরে ধীরে পিষ্ট করে রেখেছে, দমন করেছে, মারধর করেছে। শেষদিকে দেখা গেছে, তারা কোনো মিটিং-মিছিল করতে গেলেও পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়ে তা ভেঙে দিয়েছে। যতই জনসমাবেশ হোক না কেন, পুলিশ দিয়ে তা দমন করা হয়েছে। শেষবারের মতো দেখা গেল, এক বিশাল মিছিল থেকে বিএনপিকে একেবারে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলো। এভাবে পুলিশ দিয়ে মারপিট করলে বিরোধী পক্ষÑযারা নিরস্ত্র, যারা পাল্টা সশস্ত্র আক্রমণ করতে পারে না, তারা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে, অকার্যকর হয়ে যায়। এভাবেই শেখ হাসিনা তার শাসনামলে বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে অকার্যকর করে ফেলে।

একদিকে তার নিজের দমনমূলক নীতি, অন্যদিকে বিরোধিতা যাতে না হয়, সেজন্য বিরোধী দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা-এ দুই কৌশলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনা শাসন করেছে। প্রশাসন ও পুলিশি ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার মাধ্যমে সে ক্ষমতায় টিকে থেকেছে।

এত বেপরোয়া হয়ে তো বাংলাদেশে আর কাউকে এভাবে কাজ করতে দেখা যায় না। শেখ মুজিব বেপরোয়া ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার শাসনশৈলী ও শেখ হাসিনার শাসনশৈলীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ, হাজার হলেও শেখ মুজিব জনগণের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিপক্বতা তার ছিল।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা যেন ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’Ñসে শুধু শেখ মুজিবের কন্যা হওয়ায়ই ক্ষমতায় এসেছে। তার নিজের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল না। সে ‘বাপের বেটি’ হিসেবে নেতৃত্বে এসেছে। কিন্তু শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনার কিছুই সে ধারণ করেনি। বরং হাসিনা দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছে।

শেখ হাসিনার শাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী শাসন আর লুটপাট। এই যে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলা হয়, সেটি নিয়ে আমি নিজেও নিশ্চিত নই-কথাটি আসলে কী বোঝায়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে সবাই বলে যাচ্ছে কিন্তু এ চেতনার প্রকৃত অর্থ কী, তা কখনো স্পষ্ট করা হয়নি।

যদি চেতনা বলতে বোঝানো হয়Ñ১৯৭১ সালে মানুষ কী স্বপ্ন দেখেছিল, কী পেতে চেয়েছিল, তাহলে বলা যায় সাধারণ মানুষের চেতনা আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেতনার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল দুই বেলা খেতে, নিরাপদ জীবন, একটি সম্মানজনক চাকরি আর একটু নিরাপত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন ভাবছিল কীভাবে তারা সুযোগ নিয়ে সম্পদ বানাবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে।

১৯৭১ সালে যারা বাস্তবে লড়াই করেছিল, তারা ছিল সাধারণ ছাত্র, কৃষক-শ্রমিকের সন্তান, মধ্যবিত্ত তরুণ। আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী বা ছাত্রনেতাদের কারো যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ছিল না। তাদের মধ্যে অনেকেই তখন পলায়নপর ছিল।

তাহলে প্রশ্ন হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে কার চেতনার কথা বোঝানো হচ্ছে? শেখ হাসিনা যখন এটি উচ্চারণ করে, তখন সে এমনভাবে বলে যেন তার চেতনা আর জনগণের চেতনা একই। কিন্তু বাস্তবে তার ‘চেতনা’ জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। বরং এটা এক ধরনের দলীয় রেটোরিক, যার মাধ্যমে সে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে।

শেখ হাসিনা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-কে এমনভাবে ব্যবহার করেছে, যেন সেটি তার পারিবারিক সম্পত্তি। এই চেতনা এক সময় কাজ করেছে, মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, আবেগে ভেসেছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে, তার দমননীতি ও নির্যাতনের ফলে এই চেতনা ধরা পড়ে গেছে। এখন সে জনগণ থেকে শতভাগ বিচ্ছিন্ন।

যদি একটি সত্যিকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ কয়টি আসন পেত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শেখ হাসিনা ‘চেতনা’ দিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক জমিদারি কায়েম করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে কংক্রিটাইজ বা বাস্তবায়ন করার কোনো চেষ্টা সে করেনি। তার জন্য এটি শুধু একটি রেটোরিকাল অস্ত্র। সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো সুযোগ দেয়নি। শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে শেখ মুজিবুর রহমানই মুক্তির একমাত্র পুরুষ, একমাত্র নেতাÑএরকম একটি ‘ঐতিহাসিক মিথ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। অথচ বাস্তবতা হলো, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে শেখ মুজিব রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং ওই ৯ মাস যুদ্ধ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না।

এরপর যখন শেখ হাসিনা বলে তার পিতা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তখন সেটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিকৃতি বলে মনে হয়। কিন্তু তার শাসনামলে এই মিথ্যার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারেনি। যেসব তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ তার শাসনামলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তারাই এই বিকৃত ইতিহাসের বাহক।

তাছাড়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এমন একটি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাঠ্যবই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস পর্যন্ত এককভাবে উপস্থাপন করা হয়। স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে সব শিক্ষা ও গবেষণায় শেখ মুজিবকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়, যেন তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ইতিহাস। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা; সে ইতিহাস হোক, মতামত হোক, গবেষণা হোকÑসবই দমন করা হয়েছে। কেউ ভিন্ন কিছু বললে তার চাকরি যায়, উন্নতি বন্ধ হয়, হয়রানির শিকার হয়, কখনো কখনো জীবন পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।

সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের বর্ণনায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ একটি দলীয়, ক্ষমতাকেন্দ্রিক, একমুখী বয়ানে পরিণত হয়েছে; যা গণতন্ত্র, সত্য ও ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে।

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের আরেকটি দমনমূলক কৌশল ছিল সাম্প্রদায়িকতার বয়ানকে ব্যবহার করা। আওয়ামী লীগ সরাসরি ধর্মীয় বৈষম্যের রাজনীতি খুব বেশি করেনি বটে, কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট শুরু হয়েছে এবং এসব কাজ করেছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। জামায়াতে ইসলামী বা বিএনপির লোকজন এভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেনি, যতটা করেছে আওয়ামী লীগের নেতারা। পাকিস্তানি আমলে যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ছিল, স্বাধীনতার পর সেটি বাতিল করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে রূপান্তর করে বহাল রাখে, যার ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি লুটপাট অব্যাহত থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা দাবি করলেও অর্থনৈতিক স্তরে আওয়ামী লীগ ছিল চরম সাম্প্রদায়িক। হিন্দুদের অর্থ-সম্পদ দখল করাকে তারা একটি কাঠামোগত ও ব্যবস্থাগত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা খুব বেশি ব্যবহার না করলেও অর্থনৈতিক লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে এটি ব্যবহার করেছে। সমাজের প্রভাবশালী এলিট, সিভিল সোসাইটি, আমলাতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায়ী মহলÑসবাইকে দমন ও পুরস্কারের নীতিতে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যারা সরকারের অনুগত, তাদের দেওয়া হয়েছে সুযোগ-সুবিধা; যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের করা হয়েছে বরখাস্ত, বঞ্চিত, এমনকি কারাবন্দি।

শেখ হাসিনার এই ১৫ বছরের শাসন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি একটি সাংগঠনিক নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে, যার স্কেল ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি।

এর ফলে প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনিক কাঠামো যে ধ্বংস হয়ে গেছে, তার প্রমাণ ২০২৪ সালে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি আগস্টের শুরুতে সামরিক বাহিনী পর্যন্ত শেখ হাসিনার নির্দেশে গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল যে, এই সরকারের দিন শেষ।

যদিও সামরিক বাহিনী সরাসরি গুলি চালায়নি, তারা শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করে। ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে দেশত্যাগে সহায়তা করেছে। এই সহযোগিতার পেছনে ছিল তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাব-নিকাশ। কারণ সরাসরি গুলি চালালে তার ফল হতে পারত মারাত্মক।

এমনকি এখনো প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী মহলে আওয়ামী লীগের অনুগতরা রয়ে গেছে। তারা খোলাখুলি না বললেও নীরবভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ ‘কোনো দল নিষিদ্ধ করা উচিত নয়’ বললেও বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ এখন আর একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল নয়। এটি একপ্রকার ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক এজেন্টের মতো কাজ করছে।

শেখ হাসিনার সরকারের শাসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। শেখ মুজিব ভারতপন্থি হলেও তিনি ভারতের নির্দেশে চলতেন না। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতের নকশায় নির্মিত। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক নীতির প্রশ্ন নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। দলটির কার্যক্রম বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে। এটি একটি ‘ভারতঘেঁষা’ কাঠামোগত এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, যার ফলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *