
নিজস্ব প্রতিবেদক : স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দীর্ঘদিন ধরেই ভয়াবহ প্রমোশন সংকটে ভুগছে। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে সহকারী প্রকৌশলী, সব স্তরেই পদোন্নতির জট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর ১৩টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে দায়িত্বে আছেন মাত্র চারজন। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা আরও কমে একজন পর্যন্ত নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রায় দুই শতাধিক উপজেলা প্রকৌশলীর কাজ চলছে অতিরিক্ত দায়িত্বে, আর সদর দপ্তরের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে ২–৩টি দফতরের দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে হচ্ছে। ফলে কাজের গতি মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে।

এলজিইডির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পদোন্নতি প্রক্রিয়া মূলত রেষারেষি, মামলা-মোকদ্দমা ও অভ্যন্তরীণ কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে আটকে গেছে। সহকারী প্রকৌশলী থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদোন্নতিতে তিনটি গ্রুপ, ২৫৭ জনের গ্রুপ, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া জামাল গ্রুপ এবং ২০০৫ ব্যাচ, পরস্পরের বিরুদ্ধে ঠেলাঠেলি করছে। দীর্ঘদিনের এই বিরোধে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলীর অনেক পদ শূন্য হয়ে পড়বে, পোস্টিং দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবলও থাকবে না।
বিতর্কের সূত্রপাত ২৫৭ কর্মকর্তার নিয়োগ ও পদোন্নতিকে ঘিরে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০১০, ২০১১ এবং ২০১৩ সালে একই তারিখে তাঁদের পদায়ন ও নিয়মিতকরণের প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে শর্ত পূরণের ভিত্তিতে তাঁদের ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

কিন্তু ২০১৩ সালে পিএসসি নিয়োগপ্রাপ্ত একদল কর্মকর্তা এই পদোন্নতি অবৈধ দাবি করে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। চার বছর দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর আদালত রায়ে জানান, ২৫৭ জনের পদোন্নতি বৈধ এবং ২০১৫ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকাও সঠিক। জামাল গ্রুপ পরে এই রায় মেনে নিয়ে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি গ্রহণ করলেও একই বছরের শেষ দিকে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে নতুন মামলা (এএটি ৩৪২/২০২২) দায়ের করে, যা এখনো চলমান।

উচ্চ আদালতে স্থিতাবস্থার কারণে শূন্যপদে নতুন পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। জনস্বার্থে দাপ্তরিক ও মাঠ পর্যায়ের কাজ চালিয়ে রাখতে চলতি দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ২০২৩ সালের ‘চলতি দায়িত্ব ও অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান নীতিমালা’র বিধি ৩ অনুযায়ী এতে কোনো বাধা নেই, এবং নীতিমালার বিধি ১০–এ স্পষ্ট বলা আছে যে চলতি দায়িত্বকে পদোন্নতি হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তবু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি তদন্ত কমিটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় উপেক্ষা করে একপেশে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যার ওপর আদালত এখনো কোনো আদেশ দেননি। রিট পিটিশন (১৪১১৮/২০২৪) শিগগিরই হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ এই মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে ২৫৭ কর্মকর্তার কয়েকজন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন, অনেকে অবসরে গেছেন বা চাকরি ছেড়েছেন। বর্তমানে ওই গ্রুপে চাকরিতে আছেন মাত্র ১৮৫ জন। এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সংস্থার স্বার্থে সবাইকে ভেদাভেদ ভুলে এগোতে হবে। একজন চাকরিজীবীর বড় আশা প্রমোশন পাওয়া। কিন্তু এই জটিলতায় অনেকে ২৭–২৮ বছর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবেই পড়ে আছেন। এটা দ্রুত সমাধান করা জরুরি।”
প্রশাসনিক রেষারেষি ও দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের এই অচলাবস্থা শুধু কর্মকর্তাদের হতাশই করছে না, বরং দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নেও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।