!! অনুসন্ধানী প্রতিবেদন !! চট্টগ্রাম কাস্টমসে ৯২৬ টন কাপড়ের হদিস নেই : বন্ড সুবিধার আড়ালে কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির সিন্ডিকেট

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত কর্পোরেট সংবাদ চট্টগ্রাম জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

কাস্টমস হাউস চট্টগ্রাম।


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিনিধি (চট্টগ্রাম)  :  বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এ শিল্পে বন্ড সুবিধা প্রাপ্তি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চলছে কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এন এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ৯২৬ টন কাপড়ের হদিস না মেলার ঘটনা এই দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উন্মোচন করেছে।

অনিয়মের ছক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নথি বলছে — সময়সীমা : ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। প্রতিষ্ঠান: এন এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেড, সাভার হেমায়েতপুর। আমদানি: ফ্রি অব কস্ট (এফওসি) সুবিধায় ১,১১৩.৭১ মেট্রিক টন কাপড়। অনুমোদন: মাত্র ১১৩.৯৭ মেট্রিক টন। সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য ছিল ১৪৭.৮৪ মেট্রিক টন।


বিজ্ঞাপন

অপেক্ষিত মজুদ  : হিসাব অনুযায়ী গুদামে থাকার কথা প্রায় ১৮৭.১০ মেট্রিক টন। বাস্তবে পাওয়া গেছে: হদিস নেই ৯২৬.৬১ মেট্রিক টনের। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের আমদানি অনুমোদনের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। এই বিপুল পরিমাণ কাপড় গুদামে নেই, অথচ অনুমোদনহীনভাবে ছাড়পত্র পেয়েছে।


বিজ্ঞাপন

দুর্নীতির প্রক্রিয়া  : তদন্তে উঠে এসেছে—ঘুষের চক্র: কাস্টম হাউসের এক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা প্রতি কন্টেইনারে গড়ে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে বিল অব এন্ট্রি যাচাই ছাড়াই ছাড়পত্র দিয়েছেন। শুল্ক ক্ষতি: প্রায় ৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার কাপড় শুল্কমুক্তভাবে ছাড় হয়েছে। এতে সরকারের ক্ষতি আনুমানিক ৫৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। তদারকির ব্যর্থতা: উচ্চপর্যায়ের কাস্টম কর্মকর্তারা এ অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ—নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ করে ছিলেন, সেই প্রশ্ন উঠছে।

প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য বনাম বাস্তবতা :  প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমা সুলতানা দাবি করেছেন :“আমরা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে আমদানি করেছি। ৯২৬ মেট্রিক টন কাপড় উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং রপ্তানি সম্পন্ন হয়েছে। বার্ষিক অডিট শেষ হলে সব পরিষ্কার হবে।”

কিন্তু অডিট শেষ হওয়ার আগেই ১,১১৩ টন কাপড় আমদানি ও ব্যবহার—এই অসঙ্গতি কোনভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। উপরন্তু, এনবিআর জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধার কাগজপত্র জমা দেয়নি।

প্রশাসনের অবস্থান  : ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ইতোমধ্যেই ব্যাখ্যা চেয়েছে। ব্যবসা সনদ (বিআইএন) স্থগিত করার বিষয়টি বিবেচনায় আছে। এনবিআর ও কাস্টমস যৌথভাবে তদন্ত করছে। তবে তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে সংশয় আছে, কারণ ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে।

পেছনের খেলা  : রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, চট্টগ্রাম কাস্টমস দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল ও আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের আঁতাত ছাড়া এত বড় অনিয়ম সম্ভব নয়। স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কিছু প্রভাবশালী নেতার নামও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় এসেছে। তারা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে “সুরক্ষা” দিয়ে থাকে, বিনিময়ে ভাগ পায় ঘুষ ও কমিশন।

পরিণতি ও জাতীয় ক্ষতি : সরকারি রাজস্ব: বছরে কয়েকশ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি।

শিল্পখাত : সৎ রপ্তানিকারকেরা ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের সুনাম: বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দুর্নীতি সংস্কৃতি: কাস্টমস কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে।

উপসংহার   :   চট্টগ্রাম কাস্টমসে এন এইচ অ্যাপারেলসের ৯২৬ টন কাপড়ের হদিস গায়েব হয়ে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি বন্ড সুবিধাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা এক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি চক্রের সাম্প্রতিক উদাহরণ। এনবিআর ও কাস্টমস যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তবে এ ধরনের অনিয়ম আরও বেড়ে যাবে, যা শুধু সরকারের রাজস্ব ক্ষতিই নয়, দেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির জন্যও মারাত্মক হুমকি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *