গণপূর্তে সিন্ডিকেটের দখলে বরাদ্দকৃত প্রকল্প,  : ঠিকাদার চক্র ও কর্মকর্তাদের  কমিশন বাণিজ্যের অদৃশ্য কারখানা

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা প্রশাসনিক সংবাদ বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

গণপূর্ত অধিদপ্তরের আলোচিত ও সমালোচিত প্রভাবশালী প্রকৌশলীরা।


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক :  গণপূর্ত অধিদপ্তর—রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু এই দপ্তরই বহু বছর ধরে এক অদৃশ্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়েছে। টেন্ডার আহ্বান থেকে শুরু করে প্রকল্প অনুমোদন, বিল পাস, এমনকি কর্মকর্তাদের বদলি পর্যন্ত—সব কিছুতেই চলছে কমিশন বাণিজ্যের অদৃশ্য কারখানা।

অভ্যন্তরীণ সূত্রের ভাষায়, “এখানে কোনো প্রকল্প অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা প্রশাসনের অনুমোদনে নয়, বরং সিন্ডিকেটের সম্মতিতেই অগ্রসর হয়।” অভিযোগ আছে, প্রতি কোটি টাকার প্রকল্পে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন ভাগ হয়ে যায় নানা স্তরে।


বিজ্ঞাপন

আদালতে মামলা, কিন্তু অগ্রগতি নেই :  ঢাকার সিএমএম আদালতে দায়ের হওয়া সিআর মামলা নং-১১৮/২০২৫ (ধারা: ১৪৭/১৪৮/৩২৬/৩০৭/৫০৬/৩৪)–এ গণপূর্তের ২৫ জনেরও বেশি প্রভাবশালী কর্মকর্তা অভিযুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—টেন্ডার কারচুপি, প্রকল্প বরাদ্দে অনিয়ম, অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনিক অপব্যবহার।


বিজ্ঞাপন

তালিকায় রয়েছেন সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে ইএম বিভাগের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ‘বড়বাবু’ পর্যন্ত। অবসরে গেলেও প্রভাবশালী অনেক কর্মকর্তা এখনও বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা বা পরিচালক পদে থেকে সিন্ডিকেটের ক্ষমতা বজায় রেখেছেন।

কমিশন বাণিজ্যের চার ধাপ :  অভ্যন্তরীণ নথি ও কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য চালু আছে চারটি ধাপে— উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন কমিশন (৫-৭%) – সিন্ডিকেটের শীর্ষ সদস্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জন্য। ফিল্ড পর্যায়ের কমিশন (৩-৫%) – মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলী ও বিল অনুমোদনের বিনিময়ে। রাজনৈতিক কমিশন (৩-৫%) – সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মধ্যস্থদের জন্য। অফিস কমিশন (২-৩%) – বিল রেকর্ড ও হিসাব শাখায় কার্য সম্পন্নের বিনিময়ে।ফলাফল—একটি প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই ব্যয়ের ১৫-২০% ভাগ ভাগাভাগি হয়ে যায়, যা সরাসরি প্রকল্পের মান ও স্বচ্ছতা নষ্ট করে।

গোপন সমঝোতার বাজার :  একজন সিনিয়র প্রকৌশলী স্বীকার করেছেন, “যারা নিয়মিত টেন্ডারে কাজ পায়, তাদের ৭০ শতাংশই একই গ্রুপের। সরকারি দরপত্র জমা দেওয়ার আগেই তারা প্রকল্প ভাগাভাগি করে নেয়—যাকে বলা হয় অভ্যন্তরীণ সমঝোতা বাজার।”

অভিযোগ আছে, অধিকাংশ টেন্ডারেই প্রতিযোগিতা কাগজে থাকে, বাস্তবে নয়। দুই-তিনটি বিড জমা পড়লেও সেগুলো একই গ্রুপের ঠিকাদারদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। অনুমোদনের আগে নগদ টাকায় ‘অ্যাডভান্স কমিশন’ হাতবদল হয়ে যায়, যার কোনো রেকর্ড থাকে না।

অদৃশ্য টেবিল কমিটি :  প্রতিদিন বিকেলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১১ তলার করিডোরে বসে সিন্ডিকেটের অঘোষিত বৈঠক। ভেতরের কর্মকর্তারা একে বলেন “টেবিল কমিটি”। এখানে ঠিক হয়—কোন প্রকল্প কোন ঠিকাদার পাবে, কে বদলি হবে, কার বিল পাস হবে আর কে আটকে যাবে।

একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যে টেবিলে চা খাওয়া হয়, সেই টেবিলেই কোটি টাকার ভাগ বণ্টন হয়।”

অবসরপ্রাপ্তদের অটুট প্রভাব : মোসলেহ উদ্দিন, আবুল খায়ের, সোলায়মান হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ও আজমল হক মনুসহ একাধিক সাবেক প্রকৌশলী বর্তমানে বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে সক্রিয়। সরকারি চাকরি শেষ হলেও রাজনৈতিক আশ্রয় ও পুরনো সম্পর্কের জোরে তারা এখনও প্রকল্প অনুমোদন ও টেন্ডারে প্রভাব খাটাচ্ছেন।

সিন্ডিকেটের তিন স্তর :  বর্তমানে সিন্ডিকেট তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে —সিভিল সিন্ডিকেট: বিল পাস ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে। ই/এম সিন্ডিকেট: বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক ও প্লাম্বিং ইউনিটে প্রভাব বিস্তার করে। প্রশাসনিক সিন্ডিকেট: বদলি, পদোন্নতি ও অফিস অর্ডার নিয়ন্ত্রণ করে।তিন গ্রুপ একসঙ্গে কাজ করে কমিশনের ভাগ নিশ্চিত করে নেয়। ফলে ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা কার্যত অচল হয়ে গেছে।

সংস্কারের চেষ্টা, কিন্তু ব্যর্থতা :  বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার দপ্তরে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করলেও সিন্ডিকেটের চাপের কারণে তার পদক্ষেপ থমকে গেছে। বদলি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক কয়েকটি আদেশ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের আপত্তিতে স্থগিত হয়ে গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে বলেছেন, “প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবের কারণে মামলা টিকিয়ে রাখা কঠিন।”

উপসংহার :  গণপূর্ত অধিদপ্তর রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন সিন্ডিকেটের ‘লাভের খেলা’র আখড়া। জনগণের করের টাকা ভাগ হচ্ছে কমিশন বাণিজ্যে, প্রকল্প মানে পরিণত হচ্ছে দুর্নীতির স্থায়ী কারখানায়।

যতদিন পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের মেরুদণ্ড ভাঙা না যায়, ততদিন উন্নয়ন প্রকল্প মানেই হবে জনগণের স্বপ্ন নয়, বরং ক্ষমতাবানদের অদৃশ্য ব্যবসার উৎসব।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *