চাঁদাবাজি ও ক্রসফায়ারের অভিযোগ

অপরাধ আইন ও আদালত

২৮ দিনে ৫৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা

 

বিশেষ প্রতিবেদক : কক্সবাজারের টেকনাফে চাঞ্চল্যকর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহতের দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে। আর অধিকাংশ মামলায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও মিথ্যা মামলায় জড়নোর হুমকি অভিযোগে করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযোগে গত ২৮ দিনে একজন এসপিসহ ৫৯জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আর এসব মামলাগুলো র‌্যাব, ডিবি, পিবিআই ও সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। শুধু তাই নয়, থানা হেফাজতে আসামীর মৃত্যুর ঘটনায় একজন ওসি বরখস্ত এবং অপর এক থানার সহকারি পরিদর্শক (এসআই)কে থানা থেকে ক্লোজড করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা ও এসব ঘটনায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাগণ ‘বিব্রতকর’ বলে মনে করছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে হঠাৎ একের পর এক মামলার ঘটনাটি ‘ভিন্ন উদ্দেশ্য’ও বলে লক্ষ্য করছেন।
একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বলেছেন, ব্যক্তি পুলিশের দায় কখনও বাহিনী নেবে না। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর যেকোনো সদস্য অপরাধী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি হবে অপরাধী হিসেবেই। কিন্তু সমালোচনা, পুলিশ বিরোধী বিষোদগারসহ নানা অভিযোগে মামলাগুলো ভিন্ন উদ্দেশ্যে করা হতে পারে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকা-ের পর নানামুখী সমালোচনা ও মামলার মধ্যে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ এ দুটি ঐতিহ্যবাহী ও ভ্রাতৃপ্রতিম বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।’ আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনবান্ধব ও গণমুখী পুলিশ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহ অব্যাহত রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন নামক সংগঠনটি।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপসহ ২৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামরা দায়ের করা হয়েছে। আর ৫ লাখ টাকা আদায় করে আরও ৫ লাখ টাকা ঘুষ না পাওয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলার যুবক সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার অভিযোগ এনে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করা হয়েছে। নিহত সাদ্দাম হোসেনের মা গুলচেহেরের অভিযোগ ফৌজদারী এজাহার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলা হিসেবে রুজু করেন।এই মামলার ২৮ জনের মধ্যে ২৭ জনই পুলিশের সদস্য বলে জানা গেছে।
আবার কক্সবাজারের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্জিনা আকতার, কনস্টেবল মো. সুমন, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নুরুল ইসলাম ও এএসআই মো. শামীমসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এ রিয়াদ সোলতানা নুরী নামে এক নারী এই মামলাটি দায়ের করেছেন। মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার বাদি কক্সবাজারের একটি বেসরকারী কলেজের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। উক্ত থানার এক পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে মামলার বাদির প্রেমের সম্পর্ক হয়। এরপর বিয়ের প্রস্তাব দিলে তাকে নির্যাতনের অভিযোগে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার মো. জাফর (৩৫) নামের এক প্রবাসীকে তুলে নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার অভিযোগে চকরিয়া থানার ওসিসহ দুই পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। গত ১৬ আগস্ট পটিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বেশ্বর সিংহের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নিহত জাফরের মামা ও বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আহমদ নবী। উক্ত অভিযোগ আদালতে শুনানি শেষে বিচারক মামলাটি আমলে নিয়ে চট্টগ্রামের সিআইডি পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
অপরদিকে আখাউড়ায় পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আখাউড়া) আদালতে মামলা করা হয়েছে। গত ১২ আগস্ট আখাউড়া উপজেলার পৌর শহরের মসজিদ পাড়ার বাসিন্দা হারুন মিয়া বাদী হয়ে এই মামলাটি দায়ের করেছেন।
আর কক্সবাজারের রামু এলাকায় বসত বাড়িতে পুলিশের নজিরবিহীন ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় রামু থানার ২জন এসআই, ১জন এএসআই, ২জন কনস্টেবলসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। জানা গেছে, গত ২৪ আগস্ট রামু উপজেলার পশ্চিম চাকমারকুল এলাকার হাবিবুর রহমানের স্ত্রী সাবেক মহিলা মেম্বার আরেফা বেগম বাদী হয়ে এই মামলাটি দাখিল করেছেন। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ এবং সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ফৌজদারি দরখাস্তটির গ্রহণযোগ্যতা শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত দরখাস্তটি আমলে নিয়ে পুলিশ সুপার পিবি আই, কক্সবাজার’কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া রাজধানীর কদমতলী থানার এক এসআইসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ী কদমতলী থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন। কদমতলীর এমএসসি এন্টারপ্রাইজের মালিক ইমরান হোসেন গত ১৩ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম ইয়াসমিন আরা আদালতে মামলাটি করেন। আদালত মামলাটি পুলিশের ডিসি ডিবিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন-লাভোলা আইসক্রিমের এরিয়া ম্যানেজার উজ্জ্বল হোসেন, তরিকুল, জুবায়ের, মার্কেটিং অফিসার্স সানাউল হক, সজীব, আলম, শামীম ও রবিউল।
তাছাড়া, কক্সবাজারের খরুলিয়া বাজার এলাকায় গণধোলাইয়ের শিকার এক ইয়াবা ব্যবসায়ী থানা হেফাজতে মারা যাওয়ার ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজাহান কবিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। নিহত নবী হোসেন (৩৮) সদরের বাংলাবাজার পশ্চিম মুক্তারকুল এলাকার মৃত আব্দুর শক্কুরের ছেলে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে সোহেল মীর নামের এক ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা আদায় করার অভিযোগে রাজধানীর কাতোয়ালি থানার ওসিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে। রাজধানীর কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ১০ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা হয়েছে। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবি আই) নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার কোতোয়ালি থানার এসআই পবিত্র সরকার, এসআই খালিদ শেখ, এএসআই শাহিনুর রহমান, কনস্টেবল মিজান ও পুলিশের সোর্স মোতালেব আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আর গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়ায় গুলিতে মেজর (অব) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর গত ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ পুলিশে সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। উক্ত মামলায় বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এএসআই লিটন মিয়া, পুলিশ কনস্টেবল সাফানুর রহমান, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মো. মোস্তফা ও এসআই টুটুল। এদের মধ্যে মোস্তফা ও টুটুল নামের দুইজন পলাতক রয়েছেন। এরপর তদন্তসংস্থা র‌্যাব আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেন। এরা হলেন- এপিবিএনের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও আবদুল্লাহ।
তাছাড়া, রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) বেলায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ১২ আগস্ট ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা ওরফে আদার মামলাটি দায়ের করেন। উক্ত মামলায় পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেনের পাশাপাশি অজ্ঞাত আরো ১৫-১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন