থামছেই না অপরাধ

অপরাধ আইন ও আদালত

ভয়ংকর কিশোর গ্যাং

বিশেষ প্রতিবেদক : বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিওটি প্রকাশের পর কিশোরগং নিয়ে দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃস্টি হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সারাদেশেই অভিযানে নামে। কিন্তু তার পরও থামছে না কিশোর অপরাধ। শিশু-কিশোরদের এই গ্যাং নিজ নিজ এলাকায় গ্যাং বাহিনী গড়ে তুলে খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের সু-পথে আনতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে।
এদিকে গত রোববার দুপুরে রাজধানীর বকশিবাজার এলাকায় প্রকাশ্যে দিবালোকে কিশোর অপরাধীর ছুরিকাঘাতে নয়ন আহমেদ ওরফে নাদিম (২০) নামে এক যুবক খুন হয়েছেন। ঘটনার সময় ওই যুবকের সঙ্গে থাকা তার বন্ধু সোহান, নয়নকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন।
ঢামেক হাসপাতালে সোহান জানান, তারা বংশাল পিঠাঘর এলাকায় থাকেন। আর নয়ন একটি মোটরসাইকেলের ওয়ার্কশপে কাজ করেন। তারা দুই বন্ধু বৃহস্পতিবার ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। পুরান ঢাকার হোসনী দালানে ঘোরাঘুরির পর বকশিবাজার থেকে রিকশাযোগে লালবাগ এলাকায় যাওয়ার পথে বকশিবাজার মোড়ে কয়েকজন কিশোর নয়নকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। যারা নয়নকে ছুরিকাঘাত করেছেন, তারা সবাই কিশোর বয়সী। তাদের গায়ে মহরম উদযাপনের কালো ও লাল পোশাক ছিল। তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হতে পারে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় গত ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল রাসেল ওরফে রনি স্থানীয় একটি মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় বখাটেদের ছুরিকাঘাতে খুন হন। পুরাতন ঢাকার জনি নামের এক নেতা ওই বখাটেদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি স্থানীয় কমিশনারের সঙ্গে চলাফেরা করেন। তার এলাকায় রয়েছে সেন্টার বয়েস, ভাইব্রাদারসহ আরো কয়েকটি গ্রুপ। এসব গ্রুপের মূলে আছে জনি। তিনিই সব কিছু সামাল দেন। মাঝে মধ্যে গ্রুপের সদস্যদের চাঁদা উঠাতে পাঠায়। কোথাও চাঁদা আনতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হলে প্রয়োজনে মেশিনও ব্যবহার করে।
আবার (ছদ্মনামে) মাসুদ নরসিংদীর একটি কলেজে রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। রাজনীতি করতে গিয়ে জড়িয়েছেন মাদক ব্যবসায়। সেই মাদক দিয়েই এলাকায় তৈরি করেছেন নিজস্ব গ্যাং বাহিনী। এভাবে দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এই গ্যাং কালচার। আগে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোতে এই কালচার থাকলেও তা ছিমছাম-নিরব জেলা উপজেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
গত চার বছরে গ্যাং গ্রুপের হাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আলোচনায় ছিল কয়েকটি ঘটনা। গত তিন বছরে এ ধরনের ঘটনায় র‌্যাব শতাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে। দেশের সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোর মনের দুঃসাহসিকতাকে কাজে লাগাতে হবে সমাজ গঠনে। অপরাধমুক্ত সমাজ বা দেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। তবে অপরাধী কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে ডিএমপি মিডিয়া উপ-কমিশনার ওয়ালিদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অপরাধী যেই হোক তাকে কোনভাবে ছাড় দেয়া হবে না। তবে কিশোর অপরাধ কমাতে শিশু-কিশোরদের প্রতি আরো যতœবান হওয়ারও পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
অপরদিকে চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারের মাঝে ধারালো সুতার মাধ্যমে প্রথমে চলন্ত মোটরসাইকেল আরোহীদের রাস্তায় ফেলে অভিনব পন্থায় ছিনতাইয়ে জড়িত কিশোরগ্যংয়ের সদস্যরা। তারা প্রথমে ধারালা সূতা দিয়ে মোটার সাইকেল ফেলে দেয়। এরপর সাহায্যের নামে কাছে গিয়ে আহত আরোহীর মালামাল লুটে নেয়। বিপজ্জনক এসব অপরাধের সাথে চট্টগ্রামের কয়েকটি কিশোর গ্যাং জড়িয়ে পড়েছে বল চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এই সুতার কবলে পড়ে প্রায়ই গুরুতর আহত হচ্ছেন অনেকেই। সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে কিশোরগ্যাংয়ের এ চক্রের ৬ সদস্য আটকের পর অভিনব পন্থার এই ছিনতাইয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগিরা জানান, চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারগুলোতে বিকেলের পর থেকে যানবাহন চলাচল কমে যায়। আর সন্ধ্যায় লাইট না থাকলে গাড়ি নিয়ে কেউ ওই পথে যায় না। আর এ সময় শর্টকাট পথে যাওয়া মোটরসাইকেল আরোহীরা অভিনব ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। প্রাণে বাঁচলেও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন অনেকেই। তারা ফ্লাইওভারে উঠে কিছু দূর যাবার গলায় সুতা আটকে যায়। এরপর মোটরসাইকেলের গতি কম থাকায় দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু সূত্র ধারালো হওয়ায় গলায় আঘাত প্রাপ্ত হন। এসময় পড়ে গেলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এসে ছিনতাই করে নিয়ে যেত।
সূত্র জানায় উল্লেখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিনব এই ছিনতাইকারী দলের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে র‌্যাব। তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করে ৬ জনকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা স্বীকার করে দলের কম বয়সীরাই ফ্লাইওভারে খেলার অভিনয়ে ধারালো সুতা বেঁধে দেয়। আর তাদের নেপথ্যে থাকে মোটরসাইকেল নিয়ে বড় ভাইরা। সুতায় লেগে কোনো আরোহী রাস্তায় পড়ে গেলে পেছন থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে এসে আহত পথচারীর মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে কর্ণেল মশিউর রহমান জুয়েল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মানুষের জীবনের কথা চিন্তা না করে, নেশার টাকা জোগাড় করতেই তারা এই অভিনব ছিনতাই করতো। আটককৃত ছয় জনের মধ্যে শুধুমাত্র একজনের বয়স ৩২ বছর। বাকি সবাই ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে দু’জনের বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর। এই ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে।
কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা রাজধানীতে আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। একের পর এক অপরাধ করেও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। উত্তরখানে কলেজছাত্র সোহাগ খুনের প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি বখাটে হৃদয়ের বিরুদ্ধে এর আগেও নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ বলছে, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে। ঘটনার পর পার হয়ে গেছে ২ দিন। এখনো ছেলের কথা ভেবে কাঁদছেন বাবা- মা। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলো সোহাগ। ছোটবেলা থেকে মানুষের বিপদ দেখলে এগিয়ে যেত সোহাগ। এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস। মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়াই তার জীবন দিতে হলো।
জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরখানে রাজাবাড়ি মধ্যপাড়া এলাকায় এক রিকশাচালককে মারধোর করছিলো স্থানীয় যুবক হৃদয়। সোহাগ এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে সোহাগকে ছুরিকাঘাত করে হৃদয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সোহাগ। নিহত সোহাগের বাবা জানান, তার ছেলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় হৃদয় তাকে হত্যা করেছে। সোহাগের বড় ভাই বলেন, ‘হৃদয়ের নামে একাধিক মামলা আছে। আমি চাই সব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক। ঘাতক হৃদয় স্থানীয় কিশোরদের নিয়ে একি গ্যাং তৈরী করেছে। এরাকার বিভিন্ন পরিবহনসহ কল কারখানা থেকে চাঁদাবাজিই তাদের কাজ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে স্টাইল ফ্যাশনস নামক একটি তৈরি পোশাক কারখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো একটি অটোরিকশা। এসময় কাদা ছিটে কয়েকজন তরুণের গায়ে লাগলে ওই অটোচালককে মারধর করেন হৃদয়সহ ৬ তরুণ। এর প্রতিবাদ করলে সোহাগকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় তারা। পরে সোহাগকে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনায় জড়িতদের সবার বয়স ২০-২২ বছরের মধ্যে হবে বলে জানায় পুলিশ। এদের মধ্যে হৃদয় উত্তরাতে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য। এ ঘটনার পর পুলিশ জানায়, প্রধান আসামি বখাটে হৃদয়ের বিরুদ্ধে এর আগেও নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ হাতে পেয়েছে পুলিশ।
কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা সাংবাদিকদের বলেছেন, বরগুনার মত ছোট জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে। তাই এরকম হামলা যারা করছে, তারা যে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এমন অপরাধ করছে তা স্বাভাবিকভাবেই জানে মানুষ। তাদের বাধা দেওয়ার পর তারা বাধা দানকারী বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা অনুমান করেই হয়তো মানুষ বাধা দিতে যায়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক মাধ্যমে কোনো ঘটনা ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এবং অপরাধ করে ক্ষমতাসীনদের পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে এসবের প্রতিবাদ করে না বলে মনে করেন তিনি।


বিজ্ঞাপন