কাজী আরিফ : একখানা বিষন্ন মেঘ আকাশের চাঁদোয়ায় ঝুলে ছিল।আলোর কমতি থাকায় শাশ্বতীর মুখখানা দেখে বোঝা যাচ্ছিলনা সে কোনো গোপন ব্যথা আড়াল করছে কিনা ।শহরের জনাকীর্ণ রাস্তার পঙ্কিলতা একপাশে ঠেলে শাশ্বতী ত্রস্তপায়ে এগিয়ে গেল ।মেঘ না থাকলেও একটা বাজে ধরনের গরম বিরাজ করছিল সবখানে আর তাতেই ঘেমে উঠল সে।
একজন ফুলওয়ালী বাচ্চামেয়ে গোলাপের ঝাড় হাতে তুলে দিতে চাইল ।চোখে তার অনুনয় ঝরে পড়ছে ।
শাশ্বতী হেসে মাথা ঝাঁকালো-
– না রে , লাগবে না ।
‘ আপা নিন না ।এই এতগুলা গোলাপ মাত্র পুঞ্চাশ টেকা’ মেয়েটা ওর হাতে পারলে গছিয়ে দেয়।
এগারো বারো বছরের একটা অভাবী মেয়ে ।ফুলগুলো না নিলে কেমন অপরাধ বোধ হবে ।এতটুকুন একটা মেয়ে সবার কাছে গিয়ে অনুনয় করছে ফুল কেনার জন্য ।এমনও ত না সে ভিক্ষা চাইছে । তাকে এমনি দশটাকা সাহায্য করাও যাচ্ছেনা ।অগত্যা দাঁড়িয়ে পঞ্চাশ টাকা বের করে ওর হাতে দেয়ার সাথে সাথে মেয়েটা কোনক্রমে ফুলগুলো ওর হাতে গুজে দিয়েই যেন প্রজাপতির মত উড়ে চলে গেল ।
ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল এখন এই রাস্তার মধ্যে এতগুলো ফুল নিয়ে সে কি করবে ?
তাকে তো এখন একটা রিকশা নিতে হবে ।
বেশ ঝামেলায় পড়া গেল তো ।অগত্যা একটা রিকশা ডেকে তাকে উঠে পড়তে হল ফুল সমেত।ভেবেছিল দু একটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাসায় ফিরবে কিন্ত ফুলগুলোর জন্য তা আর হলোনা ,বাসার দিকেই যেতে বলল রিকশাকে ।অনেকক্ষন ঝাঁকুনি আর গলির জ্যাম সহ্য করে তবে সে বাসার সামনে এসে দাড়ালো ।
গেটের পাশে উঠে গেছে গোলাপী-সাদা মাধবীর ঝাড় ।যেন ওকে দেখেই মাথা ঝাঁকালো ।
‘কিগো শাশ্বতী, তোমার মন খারাপ কেন ?’
শাশ্বতী ঠোঁট কামড়ে ফুলগুলোর দিকে একবার প্রস্নন মুখে তাকালো।হাতের গোলাপের দিকেও নজর পড়ল ।দ্রুত গেট খুলে বাসার মধ্যে ঢুকে গেল ।ওকে দেখে এগিয়ে এসে আমেনা খালা হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে ফ্লাওয়ার ভাসের মধ্যে রাখতে লাগল,
‘খালা ,আমার কোন কুরিয়ার এসেছে ?’
‘হ দুইখান প্যাকেট দিয়ে গেছে ।আপনার টেবিলের উপর রাখছি’
কুরিয়ার থেকে তাকে ফোন করেছিল যে তার একটা প্যাকেট এসেছে ।
বাসায় দিয়ে যেতে বলেছিল । ওর জন্মদিন উপলক্ষে একজন মানুষ তাকে কুরিয়ার করেছে যে মানুষটাকে সে কোনদিন দেখেনি অথচ তাকে প্রতিদিন নিজের মনের মৌনতার মৌতাতে দিনের পর দিন একটু একটু করে গড়ে তুলেছে ।সে জানেনা এই মানুষটা কে এবং কি চায় ।হয়ত চায়না কিছুই ।কিন্ত তবু যেন একটু বাতাসের মত, একটুখানি আলোর মত সারাক্ষন পাশে লেগে থাকে ।নিরব একজন সঙ্গীর মত। শুধু সঙ্গী হয়ত না বা তারও বেশী ।কেন ?
তার এই পাশে থাকাটাকে সে মনে প্রানে খুব চায়। ও জানেনা এই চাওয়ার কি কোন পার্থিব ব্যাখ্যা আছে কিনা?তা প্রায় লাস্ট পাঁচ বছর ধরে এই মানুষটার সাথে আলাপচারিতা,খুনসুটি,শেয়ার ।আলাপ এই ফেসবুকের মাধ্যমেই ।
মজার ব্যাপার হল , মানুষটার মধ্যে কোন প্রত্যাশার ছোঁয়া নেই বলেই ধীরে ধীরে ওরা দুজনে নিজেদের কাছে সহজতর হয়েছে ।আজকাল সেই মানুষটাই যেন তার অবারিত খোলা জানালা যেখান দিয়ে হু হু করে মাতাল হাওয়া ঢোকে , মনটাকে রিফ্রেশ করে দিয়ে যায় ।তার কথায় মনটা যেমন রিফ্রেশ হয়ে যায় ঠিক তেমনি আজ দুপুর থেকেই তাকে মন খারাপ করে দিয়েছিল তার স্বামীবর ।আজও ফোনে সে যন্ত্রনা শুরু করেছে ।
‘শাশ্বতী, তোমার এই চাকুরীটা আমার ভাল্লাগছে না ।আমি চাইনা তুমি চাকুরীটা করো’ রীতিমত কতৃত্বের আভাস।
ও কিছু বলেনা ।অভ্যাসমাফিক দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ায় আর ভাবে স্বামী এমন শাসকের মত আচরন শুরু করল কেন ?সে তো তার কাছে কিছু চাইনি ।
শাশ্বতি চিৎকার করে খালাকে ডাকল,
‘খালা, এক কাপ চা রেডি কর।আমি গোসল সেরে এসে যেন পাই’ ।
বাথরুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকালো ।রাজ্যের ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরলেও চোখ দুটোতে একটা হাসি লেগে আছে ।যা দেখে নিজের মন ভাল হয়ে গেল।মনটা আর ভালো হয়ে গেল তার চোখ আর হাসি নিয়ে মানুষটার চার লাইনের কবিতার কথা ভেবে –
“তোমার দুই চোখের জন্য
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলেও বাধতে পারে।
তোমার হাসির জন্য
দুই পাঁচটা পারমানবিক বোমা
পড়লেও পড়তে পারে”
কি ভয়ঙ্কর আর সুন্দর লাইনগুলি ।
ও অবাক হয়ে এমন সুন্দর একটা অনুভূতির মধ্যে যেন সারাদিনমান বাস করে ।ভালবাসা কি শুধু পার্থিব চাওয়াপাওয়া নিয়ে ? শুধুই কি বিয়ে, শরীর, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা এসব নিয়েই থাকা। এর বাইরে কি নিজেকে খুঁজে পাওয়ার কিছুই নেই ? সংসার তো ক্রমশঃ একটা বোঝা হয়ে যাচ্ছে মানব জীবনে ।তাই যদি না হবে তবে সংসারে কেন ভালবাসা হারিয়ে যায়, কেন তবে তা ভীষন আটপৌরে হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
শাশ্বতীর বিষাদ মাখা মুখখানিতে হাসি ফুটে উঠল মানুষটার কথা ভেবে।