নিজস্ব প্রতিবেদক : ক্রমাগত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নিয়ে গণমাধ্যম এবং জনগণের কৌতুহলের যেনো শেষ নেই। এ কৌতুহল শুধু বাংলাদেশের মাণুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের ভৌগলীক সীমানা অতিক্রম করে তা এখন বিশ্বনেতাদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশকে আইডল হিসেবে দেখছে। এ বিষয়ে আইএমএফ এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন সামনে আসায় চমকে উঠেছেন ভারতের ১৩৬ কোটি মানুষ! অর্থনীতিসহ বিভিন্ন মানদ-ের সকল সূচকের অনেকগুলোতে বাংলাদেশ ভারতকে ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। বাকিগুলোতেও যাবে- এমন প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম এখন নিয়মিত খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে। ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে উপস্থাপনা হয়ে থাকে প্রামান্যচিত্র।
ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা এখন মোদী সরকারের সমালোচনায় মুখর। কীভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা দেশকে আমূল বদলে দিয়েছেন, কীভাবে দেশের মানুষ করোনাকালেও অর্থনীতিকে ভেঙে পড়তে দেয়নি; বিপরীতে মোদি সরকার কী করেছে, কীভাবে দেশটাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- এমন সব আলোচনা সমালোচনায় সরগরম ভারতের গণমাধ্যম। যে সকল রাজনীতিবিদ ইতিপূর্বে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা আপত্তিকর কথা বলেছেন, তাদের সমালোচনা করতে ছাড়ছে না টিভি মিডিয়া।
আইএমএফ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপির অগ্রগতিতে পাকিস্থানকে আগেই পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের মধ্যে ভারতকেও পেছনে ফেলতে যাচ্ছে। সংস্থাটির সাম্প্রতিক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে হতে পারে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। সেখানে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০.৫ শতাংশ কমে হতে পারে, যা দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে। অর্থাৎ এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের চেয়ে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ।
এরপর থেকেই সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছে ভারতের অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহল। কারণ, বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ভারত। বিশ্ব জিডিপিতে ভারতের অংশ যেখানে ৩.২৮ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ০.৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতির আকার ১০ গুণ বড়। তারপরও ভারতকে টপকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু লিখেছেন, যে কোনও বিকাশমান অর্থনীতির দেশের অগ্রগতির খবর অবশ্যই ভালো। কিন্তু এ খবরটি ভারতের জন্য বিরাট একটি ধাক্কা। ৫ বছর আগেও যে দেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল ভারত, এখন সেই দেশের পেছনে।
আইএমএফ বলছে, ১৯৯০-এর দশকে অর্থনীতি উন্মুক্ত করার পর থেকেই চীনের দ্রুত সম্প্রসারণকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে ভারত। তিন দশক এই লক্ষ্যে চলার পর বাংলাদেশের পেছনে পড়ায় ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। চীনকে মোকাবেলায় কার্যকর অংশীদারত্ব চায় পশ্চিমারা। কিন্তু তারা চায় না সেই অংশীদার ভারত নি¤œমধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে পড়ুক।
এ বিষয়ে নি¤œ দক্ষতা আত্মবিশ্বাসেও অভাব তৈরি করতে পারে। বড় শক্তি হওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা থাকা দেশ যদি কোনও ছোট অর্থনীতির দেশের পেছনে পড়ে যায়, যে ছোট দেশকে স্বাধীন করা জন্য ১৯৭১ সালে পাকিস্থানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল তারা। তাহলে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত সাগরে সেই দেশের প্রভাব কমে যায়।
তাহলে ভুলটা হল কোথায়? নিশ্চিতভাবে করোনা ভাইরাস এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশে নতুন সং’ক্রমণ চূড়ায় পৌঁছে মধ্য জুনে। কিন্তু দৈনিক শনাক্তের রেকর্ডের পর ভারতে তা কমতে শুরু করেছে। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে করোনায় ভারতের চেয়ে কম মৃ’ত্যু হয়েছে। করোনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৬০০ জনের মতো ম’রেছে। ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে ৮ গুণ বেশি হলেও করোনায় মৃ’তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। সবচেয়ে ক্ষ’তি হলো করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে লকডাউন কার্যকর করায় ভারতের প্রবৃদ্ধি ১০.৩ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে করে আইএমএফ। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনার প্রভাবে যে ক্ষ’তির আশ’ঙ্কা করা হচ্ছে সেটির তুলনায় এই প্রায় ২.৫ গুণ বেশি।
আর্থিক সং’কট, পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকা আর্থিক ব্যবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ভীতি ভারতের কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে আরও বিলম্বিত করবে। আরও খারাপ খবর হল, এমনকি করোনা ছাড়াও ভারত হয়তো বাংলাদেশের পেছনে চলে যেত। এই পিছিয়ে পড়ার সম্ভাব্য কারণ উঠে এসেছে পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও ভারতের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মানিয়ামের একটি নতুন গবেষণায়। তারা এই গবেষণার নাম দিয়েছেন, ইন্ডিয়া’স এক্সপোর্ট-লেড গ্রোথ: এক্সেমপ্লার অ্যান্ড এক্সেপশন (ভারতের রপ্তানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধি: উদাহরণ ও ব্যতিক্রম)।
প্রথমে ভারতের প্রবৃদ্ধির ব্যতিক্রমবাদ বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশ ভালো করছে কারণ তারা আগের এশীয় টাইগারদের পথ অনুসরণ করছে। স্বল্প-দক্ষতায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি দরিদ্র দেশের কর্মক্ষম মানুষের জন্য উপযুক্ত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে একটু এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনাম। কিন্তু দু’টি দেশই চীনের দেখানো পথে রয়েছে। কয়েক দশক ধরে চীন নিজেদের জিডিপি বেশি ধরে রেখেছে নিজেদের শ্রমশক্তির আকার নয়, বরং স্বল্প-দক্ষতার পণ্য উৎপাদনে নিজেদের একাধিপত্যকে বজায় রেখে। কিন্তু ভারত হেঁটেছে অন্য পথে। তারা তাদের কর্মক্ষম ১০০ কোটি মানুষের জন্য কারখানায় চাকরি দিতে সক্ষম এমন পণ্য উৎপাদনে যায়নি। সৌমিত্র ও অরবিন্দ লিখেছেন, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্বল্প-দক্ষতার টেক্সটাইল পোশাক খাতে উৎপাদন ঘাটতি ১৪০ বিলিয়ন ডলার। যা ভারতের জিডিপির ৫ শতাংশ।
যদি ভারতের ২০১৯ সালের কম্পিউটার সফটওয়্যার রপ্তানির অর্ধেক বাতিল হতো, তাহলে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু ওই ৬০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি তেমন, যেমন প্রতি বছর স্বল্প-দক্ষতার পণ্য উৎপাদনে হয়। এটিই প্রকৃত অবস্থা কিন্তু কেউ তা নিয়ে কথা বলতে চায় না। নীতিনির্ধারকরা কখনও স্বীকার করতে চান না যে, জুতো ও পোশাক কারখানা কখনও গড়ে উঠেনি বা জোর করে বন্ধ করা হয়েছে। এগুলো থেকেও ডলার উপার্জন করা এবং সাধারণের কর্মসংস্থান সম্ভব। এই খাত গ্রাম থেকে নগরে অভিবাসনের স্থায়ী পথ দেখাতে পারে, যা উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দরকার হয় এমন চাকরিতে এতো সহজে সম্ভব না। বাংলাদেশে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মধ্যে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ২ জন নারী রয়েছেন। এই হার ভারতের চেয়ে দ্বিগুণ। ভারতে এই হার মাত্র ২১ শতাংশ।
ভারতের জন্য আরও বড় বিপদ হল সঠিকভাবে পদক্ষেপ না নিয়ে রাজনীতিকরা অতীতের ভুল স্বীকার না করে বরং স্বয়ংসম্পূর্ণতার মধ্যে সমাধান খুঁজতে পারেন। বাংলাদেশের চেয়ে গরিব? কিছু মনে করবেন না, আমদানি বাধা তৈরি এবং দেশের অর্থনীতির জন্য পণ্য উৎপাদন করতে পারি আমরা। আসুন এভাবেই কর্মসংস্থান তৈরি করি। আকস্মিকভাবে, ভারতের অর্থনীতিতে ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের স্বনির্ভরতার স্লোগান ফিরে আসছে।
এই হতাশাকে দূর করতে চ্যাটার্জি-সুব্রাহ্মানিয়ামের গবেষণা আবারও কাজে লাগছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, জনপ্রিয় মতের বিরুদ্ধে, ভারত রপ্তানি নির্ভর প্রবৃদ্ধির উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন ও ভিয়েতনাম ছাড়া সব দেশের চেয়ে ভালো করছে। গ্লাস অর্ধেকের বেশি ভর্তি।
ভারত কম্পিউটার সফটওয়্যারের মতো প্রচুর উচ্চ-দক্ষতায় উৎপাদিত পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে। চীন এক্ষেত্রে নি¤œ সারির পণ্য উৎপাদনে অন্য দেশকে সুযোগ দিচ্ছে। অথচ ভারতের সুযোগ প্রতিযোগিতামূলক সস্তা শ্রমের মধ্যেই নিহিত। বছর বছর ৮০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রাখলে করোনা পরবর্তীতে এই চ্যালেঞ্জই ভারতের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হওয়ার কথা।
মূলত এমন সব বিশ্লেষণ চলছে ভারতীয় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে। সেই সাথে বিজেপি সরকার তথা নরেন্দ্র মোদি, তার অর্থমন্ত্রীকে ছেড়ে কথা বলছেন না নিজ দলের অনেক বড় নেতারাও। প্রকাশিত হচ্ছে মর্মভেদী কার্টুনও। বাংলাদেশ তাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার প্রশংসা করে টিভিগুলো বলছে, বাংলাদেশকে নিয়ে ট্রল করা এবার বন্ধ করুন, এপ্রিশিয়েট করুন। নিজেদের ভুলগুলোকে শুধরে নতুন ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যান। এছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যেও এখন শেখ হাসিনা বন্ধনা চলছে। যেকোনো উন্নয়নের উদাহরণ স্বরূপ ভারতীয়রা এখন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে।