জন্মদিনের শুভেচ্ছা

বিনোদন

বৃন্দাবন দাস

 

মো. মোজাম্মেল হক : বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাট্যাভিনেতা, নাট্যরচয়িতা, নাট্যপরিচালক, পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এর সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং পাবনার কৃতীসন্তান বৃন্দাবন দাসের আজ শুভ জন্মদিন। এই শুভ ক্ষণে তার দীর্ঘজীবন, পেশাগত জীবনের সর্বোচ্চ সফলতা ও আমৃত্যু সুস্থতা কামনা করি।


বিজ্ঞাপন

প্রখ্যাত নাট্যরচয়িতা, নাট্যাভিনেতা, নাট্যপরিচালক, জেলা পাবনার এক সময়ের কৃতী ফুটবল খেলোয়াড় (১৯৮৫-৯৩) বৃন্দাবন দাস ১৯৬৩ সালের আজকের এই দিনে (৭ ডিসেম্বর) পাবনা জেলার চাটমোহর উপজলার সাঁরোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা স্বর্গীয় দয়ালকৃষ্ণ দাস (১৯২৫-২০১৫) ছিলেন প্রখ্যাত কীর্তনশিল্পী; পদাবলী কীর্তন ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। দয়ালকৃষ্ণ দাস প্রায় ৫০ বছর কীর্তন গেয়ে ফিরেছেন এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার গ্রামে-গঞ্জে। মাতা ময়নারানী ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ সকাল ৮.০০ ঘটিকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৫ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন।

মির্জা ওয়াহেদ হোসেন প্রতিষ্ঠিত শালিখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃন্দাবন দাস প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু সম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চাটমোহর ডিগ্রি কলেজ (বর্তমানে চাটমোহর সরকারি ডিগ্রি কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা থেকে বিএসএস (সম্মান) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএসএস ডিগ্রি লাভ করেন।

বৃন্দাবন দাসের শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো অতিবাহিত হয় চাটমোহরে। জীবনে কোনো সময় চিন্তা করেননি যে, তিনি লেখালেখি এবং নাটকের সঙ্গে জড়িত হবেন। ইচ্ছে ছিল তার দেশের একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হবেন এবং জাতীয় দল তথা ‘আবাহনী’র হয়ে আকাশী-নীল রঙের জার্সি গায়ে খেলবেন- দেশে ও বিদেশে। ১৯৮১ সালে এই স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এলেন অচেনা ঢাকা শহরে। হাজির হলেন তার স্বপ্নের আবাহনী ক্লাবে। কিংবদন্তিতূল্য ফুটবলার অমলেশ সেনের কাছে হাজির হয়ে জানালেন তার মনোবাসনার কথা। সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন চাটমোহরে। সেখানে তিনি যে খেলার মাঠে ফুটবল খেলতেন, তার পাশেই ছিল ‘চাটমোহর সাংস্কৃতিক পরিষদ’। সেখানে নিয়মিত নাটকের রিহার্সেল এবং সংগীতচর্চা হোত। সেটা ১৯৮৫ সালের কথা। একদিন হঠাৎ করেই হাজির হলেন চাটমোহর সাংস্কৃতিক পরিষদের ঘরে। সাংস্কৃতিক পরিষদের পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ ফারুককে ঠাট্টা করে বললেন, তাকে (বৃন্দাবন দাস) অভিনয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে। গোলাম ফারুক তাকে সালাম সাকলায়েন রচিত ‘চোর’ নাটকে ছোটো একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন। সেখান থেকেই শুরু। এরপর সেখানেই বাংলাদেশ মুক্ত-নাটক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং সেই সুবাদে ‘আরণ্যক নাট্যদল’-এর কর্ণধার মামুনুর রশীদের সঙ্গে পরিচয় ও ঢাকার আরণ্যক নাট্যদলের সদস্যপদ লাভ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় নাট্যকার মামুনুর রশীদের সহকারী হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৯৪ সালে অবশ্য কিছুদিন কাজ করেন ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে জুনিয়র অফিসার পদে। ১৯৯৭ সালে আরণ্যক ছেড়ে ‘প্রাচ্যনাট’ গঠন করেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘কেয়ার বাংলাদেশে’ কাজ করেন ২০০৬ সাল পর্যন্ত।

১৯৯৭ সালে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ‘প্রাচ্যনাট’ গঠন করেন এবং দলের প্রয়োজনে ছোটো একটি মঞ্চনাটক ‘কাঁদতে মানা’ লেখেন। মূলত এই নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যনাটের শুভযাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েক বন্ধু মিলে একটি টেলিভিশন-নাটক প্রযোজনার পরিকল্পনা এবং তার লেখা পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রখ্যাত নাট্য-পরিচালক সাইদুল আনাম টুটুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাইদুল আনাম টুটুলের পরিচালনায় নির্মিত হলো তার লেখা প্রথম টেলিভিশন ধারাবাহিক-নাটক ‘বন্ধুবরেষু’। নাটকটি ১৯৯৯ সালে একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত ও দর্শকনন্দিত হয়। সাধারণ মানুষ, তাদের আবেগ, হাসি-কান্না বৃন্দাবন দাসের লেখার উপজীব্য। বিশেষ করে পাবনার আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি তার নাটকে স্থান করে দিয়ে পাবনার সর্বশ্রেণির মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন।

বৃন্দাবন দাসের লেখা উল্লেখযোগ্য নাটক : বন্ধুবরেষু, মানিক চোর, বিয়ের ফুল, গরু চোর, ওয়ারেন, টক শো, হাড়কিপটে, পত্রমিতালী, সার্ভিস হোল্ডার, ঘর কুটুম, পাত্রী চাই, তিন গেদা, আলতা সুন্দরী, ভালোবাসার তিনকাল, সম্পত্তি, সম্পর্ক, উঁট, সাকিন সারিসুরি, মোহর শেখ, কতা দিল্যেম তো, লেখক শ্রীনারায়ণ চন্দ্রদাস, ফিরে পাওয়া ঠিকানা, ডায়রী, কাসু দালালসহ প্রায় দুই শতাধিক নাটক ও ধারাবহিক-নাটক।

বৃন্দাবন দাসের লেখা মঞ্চ-নাটক : কাঁদতে মানা, দড়ির খেলা, অরণ্য সংবাদ, কন্যা ইত্যাদি। তার লেখা বই : কাঁদতে মানা (মঞ্চ-নাটক), বৃন্দাবন দাসের দুটি নাটক (টিভি-নাটক), সুরের আলো (গল্পগ্রন্থ)।

১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বৃন্দাবন দাস ‘চাটমোহর সবুজ সংঘ’-এর অন্যতম সংগঠক ও কৃতী ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পাশাপাশি পাবনা জেলা যুব ফুটবল দলসহ পাবনা মোহামেডান ক্লাব ও পাবনা ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ এবং ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের ক্লাব- আদমজি জুট মিলস, সিটি ক্লাব ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম খেলোয়াড় মনোনীত হন। দুর্ভাগ্যবশত অনুশীলনের সময় আহত হয়ে অনেকদিন মাঠের বাইরে থাকতে হয়। তিনি বিভিন্ন জেলায় বহু টুর্ণামেন্টে অংশগ্রহণ এবং অনেকটিতে শ্রেষ্ঠ-খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ১৯৮৪-৮৬ সাল পর্যন্ত পর পর তিন বছর চাটমোহর উপজেলার বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে সবুজ-পদকে ভূষিত হন।

নাটকে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি-স্বরূপ তিনি বাংলাদেশ চলচিচত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) এবং বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিআরএ) কর্তৃক সেরা নাট্যকার পুরস্কার লাভ করেন। কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) কর্তৃক সেরা নাট্যকার হিসেবে মনোনীত হন। এছাড়া তিনি বিনোদন বিচিত্রা, টেনাশিনাস, ট্যাব, আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড, প্রতিবিম্ব (অস্ট্রেলিয়া)সহ বহু সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন।