নীলফামারী প্রতিনিধি: আজ ১১ ডিসেম্বর নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা সর্বত্রই পাকিস্থানী হানাদার বাহীনিকে পরাজিত করে ডিমলাকে একেবারেই মুক্ত করা হয়। ফলে দিনটিকে এখন ডিমলার সর্বস্তরের মানুষ ডিমলা মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে।
এ অঞ্চলের ভারতীয় প্রশিক্ষন শেষে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুত্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ”ডিমলা”কে শত্রু মুক্ত করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপন লড়াই আর মুক্তিগামী জনগনের দূর্বার প্রতিরোধের মূখে নীলফামারীর মহকুমার ডিমলায় পতন হয় পাক হানাদার বাহিনীর।
ডিমলায় ৭১’এর ১১ ডিসেম্বর সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মূক্তির উল্লাস। ডিমলা শত্রু মুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে আসতে থাকে ডিমলা শহরের দিকে। সন্ধ্যার মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্র বর্তমানে শুটিবাড়ী মোড় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসম্ভ ”স্মৃতি অম্লান” চত্তর এলাকায় লোকে লোকারন্য হয়ে যায়। শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে শহর ও আশ-পাশের গ্রাম। আনন্দে উদ্বেলিত কন্ঠে স্বদেশের পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে বীর মুক্তিযোদ্ধারাসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকল সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ। এদিন সকাল থেকে দারুন উত্তেজনা নিয়ে শহর,বন্দর, জনপদ ও লোকালয়ের মানুষ জড়ো হতে থাকে ডিমলার প্রাণ কেন্দ্রে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে আনন্দ মিছিল।
পরদিন ১২ ডিসেম্বর বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষ জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে ও বিজয়ের পতাকা নিয়ে আনন্দ মিছিলে মেতে উঠে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কালো রাত্রীতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ডিমলার মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ। মূলত নভেম্বর এর প্রথম সপ্তাহ থেকে শরু হয়ে ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাক-বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় ডিমলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল।
এর মধ্যে ৬নং সেক্টরটি শুধুু বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর সেটি অবস্থিত নীলফামারীর জেলার পার্শ¦বর্তী জেলা লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর এম খাদেমুল বাশার। বাকী ১০টি সেক্টর ছিল ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। আর নীলফামারীর ডিমলা ছিলো ৬নং সেক্টর এর আওতাধীন।
কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহ্জ্জা আশরাফ আলীর সাথে তিনি জানান, ১৫ অক্টোবর এ অঞ্চলের দুই জন বাঙ্গালী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের কথা বলে তারা মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে ডাঙ্গারহাটের পাশ দিয়ে পাকিস্থানী ক্যাম্পে যায়। সেখান থেকে ফেরত আসার সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাদেরকে আনফিট ভেবে মুক্তিবাহীনির ক্যাম্প থেকে ফেরত পাঠিয়েছে। এরপর থেকে তাদের দু’জনকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার দুই/তিন দিন পরেই অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর ডাঙ্গারহাটসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি হিসেবে ডিমলার ডাঙ্গারহাট, টুনিরহাট, শুটিবাড়ী ও গয়াবাড়ী এলাকাগুলি পাক-বাহিনীরা ভোড়ে একযোগে এসব এলাকার প্রায় সহ¯্রাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ী অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়।
এ সময় সাধারণ জনগণের মধ্যে শুধুমাত্র ডাঙ্গার হাটেই নিহত হয় ১১ জন। যা এখন ডাঙ্গার হাট ট্রাজেডী নামে পরিচিত। নিহত হয় উল্লেখিত এলাকাগুলির প্রায় শতাধিক সাধারণ মানুষ। তিনি বলেন, আসেল ঐ দুই জন ছিলো পাক সেনাদের গুপ্তচর ও রাজাকার। ৭১’এর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পর সিদ্দিক কোম্পানী ৬ নভেম্বর মুক্ত করা হয়। এসময় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ কালে সাধারণ মানুষ প্রাণ দেয় ৬ জন।
মুক্ত দিবসের এসব বিষয় নিয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা হয় ডিমলার বীর মুক্তিযোদ্ধা এফএফ নম্বর-৩৬/৪৫ কল্যাণ ট্রাষ্ট নম্বর-৪১৪৩৩৩ ৭১’র রণাঙ্গনের অন্যতম বীরযোদ্ধা আবুল কাশেম সরকারের সাথে ৭১’ এর বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে জানালেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান দৃশ্যপট। তিনি বললেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিবাহিত হলেও দেশটির এখনও রাজাকার মুক্ত হতে পারেনি। মিলেনি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি।
এ জন্য তিনি এ মহান মুক্ত দিবসের এই দিনে উপজেলায় প্রায় ১৫৯ জন রাজাকার রয়েছে তাদের বিচারের আওতায় এনে ডিমলাকে রাজাকার মুক্ত ঘোষনা করতে সরকারের প্রতি আহবান জানান। এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্জ আশরাফ আলী জানান, ১১ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ডিমলা পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। তবে এই যুদ্ধে শহীদ হন খগাখড়িবাডী ইউনিয়নের সামসুল হুদার পুত্র মুক্তিযোদ্ধা সামছুল কিবরিয়া (মুক্তা), খগাখড়িবাডী ইউনিয়নের দোহলপাড়া গ্রামের সতীশ কমল সিংহ রায়ের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র রায়, রংপুর কাউনিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সামছুল আলম, কুড়িগ্রাম নাগেশ্বরির মুক্তিযোদ্ধা আরশাদ আলী, পঞ্চগড় সাকোয়ার মুক্তিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী ও সপন কুমার বকসি, লালমনিরহাটের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম ও আঃ গনি, নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান পাটোয়ারী, ডিমলা ছোটখাতা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলী, আরান আলী, আঃ কুদ্দুসসহ আরও অনেকে।
তিনি বলেন, ১৮ নভেম্বর ভোরে পাকসেনা, রাজাকার-আলবদর ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের উপড় ঝাঁপিয়ে পড়লে পাক- সেনাদের দোসর গুপ্তচর ও রাজাকারদের সাথে সম্মুথ যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তার নাম ছিলো মোহাম্মদ আলী। এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন শায়িত পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নে। উক্ত ইউনিয়নে ৯ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ডিমলার পুরান থানা এলাকায় শায়িত আছেন ০১ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর গণকবর হিসেবে রয়েছে শুটিবাড়ী ও ডাঙ্গার হাটে।
১৯ নভেম্বরের পর থেকেই মূলত পালাক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ছডিয়ে পড়ে ডিমলার সর্বত্রই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ১১ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ডিমলা অঞ্চল।