আবারো আতঙ্ক

অপরাধ এইমাত্র রাজধানী

রাজধানীতে আন্ডারওয়াল্ডের সেভেন স্টার গ্রুগ!

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : তরুণ সুইচ বিজ্ঞানী ভিক্টর ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। আর সেই দানবের হাতেই তিনি খুন হন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা হতো। চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাজধানীতে একের পর এক প্রকাশ্যে গুলি করে খুনের নেশায় মেতে ছিল ডনেরা। তারা বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে মেতেছিল।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা ’৯০ সালের পর সবচেয়ে বেপরোয়া হয়। তাদের লাগাম টেনে ধরাটা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আর মোস্ট ওয়ান্টেডরা নিজেদের ‘মহারাজা’ আর ‘যুবরাজ’ পরিচয় দিয়েও খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ করে। এক গ্রুপ থেকে বহু গ্রুপ হয়। আধিপত্য বিস্তারে গ্যাং কিলিং হতে থাকে। খুন, পাল্টা খুনে নগরী আতঙ্কিত। এসব অপরাধীরা রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তৎকালীন সরকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পরিচয়ে ২৩ জনের তালিকা প্রকাশ ও গ্রেফতারে পুরস্কারও ঘোষণা করে।
দীর্ঘদিন পরে আবারো সেই আদলে শীর্ষ সন্ত্রাসী পরিচয়ে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে অপরাধীরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের টিম বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে শুক্রবার ৬জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন, বেল্লাল খান, রাকিব খান টিটুল, মো. আ. হান্নান, মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. সোহাগ ও মো. খোরশেদ আলম। তাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজিতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছে।
মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার অতিরিক্ত ডিআআইজ পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, গ্রেফতারকৃত চাঁদাবাজ চক্রটি তিনটি গ্রুপে কাজ করতো। প্রথম গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন গাইড, ডিরেক্টরি ও নামিদামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় গ্রুপ টার্গেটকৃতদের সেভেন স্টার গ্রুপের পরিচয়ে ফোন করে। তাদের সদস্যরা জেলহাজত থেকে ছাড়াতে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন বলে মোটা অংকের টাকা দাবী করে। দাবীকৃত চাঁদা প্রেরণের জন্য বিকাশ, নগদ রকেট এ্যাকাউন্ট প্রেরণ করে। টাকা না দিলে তাকে ও পরিবারের সদস্যদের অপহরণ ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এতে ভয় পেয়ে তারা তাদের এ্যাকউন্টে টাকা পাঠাতো। পরে তৃতীয় গ্রুপ ভিকটিমের প্রেরিত টাকা সংগ্রহ করতো। শীর্ষ সন্ত্রাসী সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য মালিবাগের জিসান মাহমুদ পরিচয়ে একজনের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। তিনি ৩৫ হাজার টাকা প্রদানও করেন। উক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযানে চালিয়ে ৬জনকে গ্রেফতার করা হয়।
জানা গেছে, একসময় রাজধানীতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে খুনাখুনি করতে ভয়ঙ্কর সব আগ্নেয়াস্ত্র আসে। এতে নগরবাসি জিম্মি হয়। এমনই এক টালমাটাল অবস্থায় সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশ ও পুরস্কার ঘোষণার পরও জেলখানা থেকেও কলকাঠি নাড়তে থাকে। আর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত নগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি আওরঙ্গ। পরে তিনি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার তালিকায় নাম লেখান। ১৯৮১ সালে সাকুরা বার-এর সামনে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। আর নব্বইয়ের দশকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রভাবশালীর খাতায় লিয়াকত এবং মুশফিকুর রহমান হান্নান ওরফে বড় হান্নান নাম।
১৯৯১ সালে আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইন ও গোলাম রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরের নাম। পরে সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেনে স্টারের নেতৃত্ব দেন সুব্রত বাইন। ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল এবং অশ্রু যোগ দেয়। অন্যদিকে সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেয় মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, টোকাই সাগর, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু এবং জন। লিয়াকতের সঙ্গে শত্রুতায় আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলায় সুব্রত বাইনের সঙ্গে। এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সুব্রত বাইনের। পরে সুব্রত বাইনের গ্রুপ থেকে গোপীবাগের ‘সন্ত্রাসী’ আসিফ যোগ দেয় লিয়াকত গ্রুপে।
সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পিচ্চি শামিম, টোকাই মিজান যোগ দেয় লিয়াকতের গ্রুপে। সুব্রত বাইন ও লিয়াকত গ্রুপে খুন-পাল্টা খুন চলে। নিজ দলের কলহে মারা যান কয়েক জন। ২০০ সালে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্ষমতা দখলে সেভেন স্টার এবং ফাইভ স্টার গ্রুপ ডিএনসিসি টেন্ডার নিয়ে প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধে। চলে খুন-পাল্টা খুন। এবছর জজ কোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন হন হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলন। সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহিদ এই হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। ২০০১ সালে ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে টিক্কা নিহত হয়।
একপর্যায়ে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ব্ল্যাক প্যান্থার, টাইগার, পাইথন আর কোবরা বিভিন্ন নামে ভয়ঙ্কর বিষধর হিংস্র প্রাণীর নামে গড়ে ওঠে। আন্ডারওয়ার্ল্ড ১৩টি ভাগে তান্ডব চালায়। কলাবাগান, গ্রীন রোড, পান্থপথ, সোবহানবাগ নিয়ন্ত্রণ করে তানভীরুল ইসলাম জয়। সুইডেন আসলামের দখলে থাকে ফার্মগেট, নিউ ডিওএইচএস, রাজাবাজার, তেজতুরিবাজার ও কারওয়ানবাজারের একাংশ। মিরপুরের ডন বিকাশ কুমার বিশ্বাস আর তার ভাই প্রকাশ কুমার বিশ্বাস। মোহাম্মদপুরে তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ ও পিচ্চি হেলাল। আর কাঁঠালবাগান, কারওয়ানবাজারের একাংশ, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোডের দখল নেয় পিচ্চি হান্নান। হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দখল নেয় লেদার লিটন, সিদ্ধেশ্বরীতে খুরশিদ আলম রাশু, ধানমন্ডি, ইমন। মিরপুরের কিলার আব্বাস ও কালা জাহাঙ্গীর। তাছাড়া, জুরাইন, পোস্তগোলা ও গে-ারিয়ার কমিশনার শাহাদাতের হাতে। পরে কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর হাতে কমিশনার শাহাদাত খুন হলে এলাকার নিয়ন্ত্রণ পায় কালা জাহাঙ্গীর। পুরান ঢাকায় আগা শামিম এবং ইস্কাটন, মৌচাক, মগবাজার ও বাংলামোটর এলাকার নিয়ন্ত্রণ থাকে লিয়াকত-হান্নান বাহিনীর হাতে। সন্ত্রাসীদের মধ্যে এ সময় শুরু হয় খুন পাল্টা খুন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে দিনে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় সন্ত্রাসীরা। চাঁদাবাজি খুনসহ নানা অপরাধে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন টালমাটাল সময়ই আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ১৯৯৮ সালে সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশ করে। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বার সরকার ২৩জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কালা জাহাঙ্গীর, প্রকাশ বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, পিচ্চি হান্নান, আলাউদ্দিন, আগা শামিম ও আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১ লাখ টাকা এবং লিয়াকত ও তার ছোট ভাই কামরুল হাসান ওরফে হান্নানসহ ১২ জনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে গণপিটুনিতে মারা যান আলাউদ্দিন। আর বেশ কয়েকজন পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে অভিযোগ থেকে অব্যাহতিও পেয়েছেন বলে জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন