পোল্ট্রিখাতের উন্নয়নে আসছে বড় প্রকল্প

অর্থনীতি এইমাত্র

বিশেষ প্রতিবেদক:
নানাবিধ বাধা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ডিম ও মুরগির মাংস রফতানির বিপুল সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রিখাত। আর তাই এ খাতের উন্নয়নে পোল্ট্রিখাতের ১২৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। সে লক্ষ্যে পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ নামের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পের মাধ্যমে আমিষের ঘাটতি পূরণে বেশি মাংস ও ডিম উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পোল্ট্রির গুণগতমান বাড়াতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে নতুন করে কর আরোপ ও কৃষির উপখাত হওয়া সত্ত্বে উচ্চ সুদের ঋণসহ নানা কারণ, সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র জানিয়েছে , প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এদেশের মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে আসছে। গত ২০ থেকে ২৫ বছরে হাঁস-মুরগি পালনের এই পেশাটি ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন হয়ে বাণিজ্যিক বা শিল্পের আকার ধারণ করেছে। এদেশে ২৩ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন গরু, ১ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন মহিষ, ২৫ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ছাগল, ৩ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ভেড়া এবং ৩২৯ দশমিক ২ মিলিয়ন হাঁস-মুরগি রয়েছে। জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। যার ফলে গত এক দশকে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৫, ১৪২ দশমিক ৩ এবং ১০৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে একজন মানুষ বছরে ২৪০টি ডিম খেয়ে থাকে।
সূত্র আরো জানায়, প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম গুলো হচ্ছে, পোল্ট্রি প্রজাতিগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও জাত উন্নয়নের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা, নিরাপদ মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধিও জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা ৩৫টি, ৬ হাজার ৮০৪ জন খামারীদের পোল্ট্রি প্রযুক্তি বিষয়ক এবং গবেষকদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া, সাভার বিএলআরআই এর প্রধান কার্যালয়ের পোল্ট্রি রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সাব সেন্টার স্থাপন, বিজ্ঞানী, গবেষক রিসার্চ ফেলোদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোলাবোরেশনের মাধ্যমে গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অফিস ভবন গবেষণাগার ও গবেষণা সেড নির্মাণ করা হবে।
এ বিষয়ে কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের পোল্ট্রিখাতে আমূল পরিবর্তন আসবে। পোল্ট্রি প্রজাতিগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ, জাত উন্নয়ন এবং অধিক মাংস ও ডিম উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ল্যাবের সঙ্গে সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। তাই প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোঃ আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, বর্তমান সরকার কৃষি ও পোল্ট্রি বান্ধব। এ খাতের উন্নয়নে জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালা ও পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করতে মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন-২০১০ ও নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। পোল্ট্রির উন্নয়নে এ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নে কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও কর কমানো, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে শূণ্য করা দরকার। পোল্ট্রির শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম নেওয়ার মাধ্যমে নিরাপদ মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি, ছোট মাঝারী ও বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামারীদের প্রযুক্তিগত সহযোগীতা দেয়া প্রয়োজন সে লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন জরুরি।
মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান ২ দশমিক ৪ শতাংশ। লাভজনক, টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব পোল্ট্রি প্রযুক্তি কৃষি পদ্ধতির উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা তথা আমিষের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অধিক জনসংখ্যা, ক্ষরা, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কম, নিরক্ষরতা, গ্রামীণ দারিদ্রতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এদেশে প্রাণীসম্পদ ও পোল্ট্রির উৎপাদন অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফও) এর তথ্য মতে গ্রামীণ ও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারীদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে প্রাণিসম্পদের অবদান প্রায় ৭০ শতাংশ। তাই, প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয় এটা সমাজের হতদরিদ্র মানুষের বাঁচার জন্য আশার আলো হিসেবে কাজ করছে এবং সে সাথে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের অন্যতম খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আশির দশকে শুরু হওয়া এই শিল্পের বিনিয়োগ বর্তমানে ছাড়িয়ে গেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে কর্মরতদের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *