শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় এইচ টি ইমামকে শেষ বিদায়

এইমাত্র জাতীয়

বিশেষ প্রতিবেদক : শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শেষ বিদায় নিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কৃতি এ মানুষকে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক এই উপদেষ্টাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার আছর নামাজের পর গুলশানের আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় নামাজের জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে প্রথমে রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম (বীর প্রতীক) ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন। তার মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত শহীদ মিনারে রাখা হয়।
এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, উপদেষ্টাম-লীর সদস্য মুকুল বোস, সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আব্দুর রহমান প্রমুখ। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এইচ টি ইমামের মতো কর্মপাগল ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ সমাজে বিরল। তিনি দেশের জন্য অনেক কাজ করে গেছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন, কিন্তু কাজ থেকে কখনও অবসর নেননি। এইচ টি ইমামের মৃত্যুতে যে শূন্যস্থান তৈরি হলো তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।
এইচ টি ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগসহ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষ। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এইচ টি ইমামের কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বুধবার রাত ১টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক (এইচ টি) ইমাম। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। এ তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। কিডনি জটিলতাসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি হন এইচ টি ইমাম।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে তিনি রাঙামাটির জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদায় জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। এইচ টি ইমাম আমৃত্যু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এবং প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। হোসেন তৌফিক ইমামের (এইচ টি ইমাম) প্রতিটি কর্মে দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস গণমাধ্যমকে এ কথা বলেন।
ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, এইচটি ইমাম একজন অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ আগাগোড়াই একজন দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন এবং তিনি তাঁর প্রতিটি কর্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন।
ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস আরও বলেন, তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ ও নিষ্ঠাবান আমলা ছিলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সকল পর্যায়ে তিনি তাঁর দক্ষতা ও দেশপ্রেমের প্রমাণ রেখেছেন।
দেশের প্রয়োজনে এইচটি ইমামের অবদান তুলে ধরে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠভাবে ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেনের সময় জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি সংগ্রামে তিনি বিরল ভূমিকা পালন করেছেন।
এইচ টি ইমামের জানা-অজানা :
এইচ টি ইমামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরে। পিতা তাফসির উদ্দীন আহমেদ বি. এ. বি. এল. ও মাতা তাহসিন খাতুন। পুরো নাম হোসেন তৌফিক হলেও পরে তিনি এইচ টি ইমাম নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন।
বাবার চাকুরির সূত্রে শৈশবে রাজশাহীতে অবস্থান এবং রাজশাহীতেই প্রাথমিক শিক্ষা। পরবর্তীকালে লেখাপড়া করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও কলকাতায়। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এইচ টি ইমাম। আর ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি নিয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি নেন। তখন তিনি বাম ছাত্র সংগঠনে যুক্ত ছিলেন।
পড়াশোনা শেষে রাজশাহী সরকারি কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এইচ টি ইমাম। এরপর তিনি পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬১ ব্যাচের সিএসপিদের মধ্যে তিনি ৪র্থ স্থান লাভ করেন এবং পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে ‘উন্নয়ন প্রশাসনে’ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের লোভনীয় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশের পক্ষে কাজ করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হন তিনি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ অগাস্ট পর্যন্ত তিনি মন্ত্রিপরিষদের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সাভারের লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত তিনি সড়ক এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব-এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত পরিকল্পনা সচিবের পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া যমুনা মাল্টিপারপাজ ব্রিজ অথরিটির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অবসর নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন এইচ টি ইমাম। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। দলের নির্বাচন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি, যে কমিটির চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে উপদেষ্টার দায়িত্ব দেন। প্রথমে তিনি জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৪ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। এইচ টি ইমাম নিজে নির্বাচনে না দাঁড়ালেও তার ছেলে তানভীর ইমাম সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য।


বিজ্ঞাপন