লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

রোগীর চাপ সামলাতে কতটা প্রস্তুত হাসপাতালগুলো?
করোনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু
ডেল্টার চেয়েও ভয়ঙ্কর ডেল্টা প্লাস!

 

বিশেষ প্রতিবেদক : অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু। দেশে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। ইতিমধ্যে একদিনে শনাক্ত অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ফলে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে করোনা রোগীর চাপ।
সামনে আরো রোগী বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে বেশি অসুস্থ রোগীদের নিতে হচ্ছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউতে)। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে আইসিইউর শয্যা সংখ্যা। ঢাকার বড় চার হাসপাতালে এখন ফাঁকা নেই কোনো আইসিইউ শয্যা।
এই অবস্থায় সংক্রমণ আরও বাড়লে রোগী চাপ কতটা সামাল দেওয়া যাবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধিনিষেধ প্রতিপালনে অতীতের মতো গাফলতি হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে আরও ১১২ জন। যা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৮ জনে। এছাড়া একদিনে নতুন করে করোনা পজিটিভ হয়েছেন আরও ৭ হাজার ৬৬৬ জন। এতে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৯ লাখ ৪ হাজার ৪৩৬ জন। মঙ্গলবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪ হাজার ২৭ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ১১ হাজার ৭০০ জন। এদিন মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৩২ হাজার ৬৫৯ জনের। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ (প্রায় ২৪ শতাংশ)।
এর আগে, সোমবার (২৮ জুন) দেশে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আরও ১০৪ জন। এছাড়া রেকর্ড সংখ্যক ৮ হাজার ৩৬৪ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়।
দেশের এ যাবতকালে করোনায় মৃত্যুর সব রেকর্ড ছিল গত রোববার। ওইদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে আরও ১১৯ জন। এছাড়া, চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল দেশে করোনায় দ্বিতীয় সর্বাধিক ১১২ জনের মৃত্যু হয়। গত ২৫ জুন মারা যান ১০৮ জন। এছাড়া ১৮ এপ্রিল ১০২ জন মারা যান। ১৬, ১৭ ও ২৫ এপ্রিল মারা যান ১০১ জন করে।
এদিকে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন আরও ৬ হাজার ৫ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ জন।
এ নিয়ে বিশ্বে এখন পর্যন্ত মোট করোনায় মৃত্যু হলো ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ১৮৪ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ কোটি ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯৩ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৩ জন।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পরিচালক ডা. সরোয়ার উল আলম বলেন, ‘রোগীর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সোমবার ২৪ জন নতুন এসেছে। দেখা যাক সামনে পরিস্থিতি কী হয়। যতক্ষণ বেড আছে ততক্ষণ তো ভর্তি নিব। আমরা চাই একজনকেও যাতে হাসপাতালে না আসতে হয়। ‘
ঢাকায় আইসিইউ-সাধারণ বেডের চিত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সোমবার পর্যন্ত ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড – কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোনও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই।
কুর্মিটোলার ১০টি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০টি, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ বেডের সবকটিতে রোগীতে ভর্তি আছে। কুর্মিটোলার করোনা ইউনিটের ২৭৫ সাধারণ শয্যাতে অতিরিক্ত আরো সাত জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এছাড়াও করোনা ডেডিকেটেড কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ২৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে চারটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেডের মধ্যে নয়টি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয় বেডের মধ্যে ছয়টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ বেডের মধ্যে দুটি, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টি বেডের মধ্যে দুটি, ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের পাঁচটি আইসিইউ বেডের মধ্যে তিনটি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টি বেডের মধ্যে চারটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের মধ্যে তিনটি আর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের ২১২ আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি রয়েছে ১২০টি।
তথ্যমতে, ঢাকার ১৫টি সরকারি হাসপাতালের ৩৮৪টি আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি আছে ১৫৩টি। অন্যদিকে সরকারি এসব হাসপাতালে তিন হাজার ৫১৯টি বেডের মধ্যে ফাঁকা আছে ২০৫৪টি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, যে হারে নতুন রোগী আসছে তাতে দ্রুত সময়ে বেড শেষ হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে ঢাকার ২৮টি বেসরকারি হাসপাতালের ১৭২৫টি সাধারণ বেডের মধ্যে ফাঁকা ছিল ১১৫৪টি। এসব হাসপাতালের ৪৪১টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ২৭৯টি ফাঁকা ছিল।
এদিকে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলাওয়ারী তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে করোনার ডেডিকেটেড ১২হাজার ৮০২টি সাধারণ বেডের মধ্যে ৭ হাজার ১৩১টি ফাঁকা আছে।
আর ১১৫০ টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৫৫০ টি ফাঁকা আছে। এরমধ্যে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা কম ফাঁকা আছে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি বাড়ছে দ্বিগুণ। অন্যদিকে ছাড়পত্র নিয়ে চলে যাওয়ার সংখ্যা কমছে। সোমবার ২৭জন ভর্তি হয়েছে আর ৯জন হাসপাতাল ছেড়েছে। সামনে চাপ বাড়ার আশঙ্কা আছে।
প্রস্তুতি কেমন আছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় এখন প্রস্তুতি ভালো। সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনে যুক্ত আছে ৩২০টির মত বেড। আইসিইউ আগে ছিলো ১০টা এখন ২৪টা বেড আছে। সে হিসেবে প্রস্তুতি দ্বিগুণেরও বেশি আছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে রোগী বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তখন এক হাজার বেড করলেও তো সামাল দেওয়া যাবে না।
ডেল্টার চেয়েও ভয়ঙ্কর ডেল্টা প্লাস! : ভারতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ডেল্টা। সম্প্রতি দেশটিতে অতিসংক্রমণশীল আরেকটি ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এ ধরনটিকে বলছেন ডেল্টা প্লাস। এটি সংক্রমণের দিক থেকে ডেল্টার চেয়েও দ্রুতগামী। এ নিয়ে কেবল ভারতই নয়, বিশ্বের অনেক দেশই উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে।
ডেল্টা প্লাস ঠেকাতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অধিকতর সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কোভিড-পরীক্ষাও বাড়ানো হয়েছে। সোমবার কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহেতু মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ডেল্টা প্লাসের ক্ষেত্রে খুব বেশি কার্যকর নয় এবং ফুসফুসের চারপাশে কোষগুলোর বাঁধন আরও দ্রুত ভেঙে ফেলতে পারে, তাই এই নতুন ধরন নিয়ে চিকিৎসকেরা এখনও ধন্দে রয়েছেন। এ কারণে ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউয়েরও আশঙ্কা রয়েছে। নতুন এ ধরনের দাপট কতটা হবে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, টিকাকরণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কোভ্যাক্সিন বা কোভিশিল্ড যখন পরীক্ষা করা হয়েছিল, তখন করোনার এ নতুন ধরনগুলোর অস্তিত্ব ছিল না। তাই ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাসের উপর কোনও প্রতিষেধক কতটা কার্যকরী, সেটাই এখন আসল প্রশ্ন।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, প্রতিষেধক নেওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেগুলো ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাসের সঙ্গে লড়তে সক্ষম নয়। কিন্তু হালের গবেষণা বলছে অন্য কথা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়, কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিন দুই-ই ডেল্টা প্রজাতির ক্ষেত্রে কার্যকর। কিন্তু কতটা কার্যকর বা কত সংখ্যক অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে, এ ধরনের তথ্য এখনও প্রকাশ্যে আনা হয়নি। গবেষণা চলছে এবং খুব তাড়াতাড়ি ফল জানা যাবে। কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিনের পাশাপাশি ভারতে পাওয়া যাচ্ছে স্পুটনিক ভি টিকাও। রাশিয়ায় তৈরি এ প্রতিষেধকের নির্মাতারা জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত করোনার যে কটা প্রজাতির খোঁজ মিলেছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর স্পুটনিক ভি। ডেল্টা ধরনও তার মধ্যে পড়ে। ভারতে খুব তাড়াতাড়ি আসতে পারে ফাইজার প্রতিষেধক। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডেল্টা প্রজাতির বিরুদ্ধে ফাইজার প্রতিষেধক অনেকটাই কার্যকরী।


বিজ্ঞাপন