অদম্য মুজিব

জাতীয়

আজকের দেশ ডেস্ক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে, রাজনীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা ১৯৩৯-এ। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে আমরা জানতে পারি, ১৯৩৬ সালে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হন। তার ভাষায়— ‘তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।’ এই পূর্ণচন্দ্র দাস ছিলেন বাঘা যতীনের সহকর্মী। মাদারীপুরে একসময় তিনি নিজেই একটি বিপ্লবী দল গড়েছিলেন। নিজের আত্মজীবনীতে শেখ মুজিব লিখেছেন, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে স্বদেশীদের সভায় তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকেন। ফলে তিনি মনে-প্রাণে ইংরেজ শাসনবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর একজন ভক্তে পরিণত হন।
জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি একজন ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে গড় তোলেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে অখণ্ড পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতায় পরণিত হন। তার হাত ধরেই স্বাধীনতা অর্জিত হয় বাংলাদেশের। কিন্তু তার এই বিবর্তন সর্ম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
১৯৩৮ সাল। কিশোর শেখ মুজিবের জীবনের একটি মাইলফলক। অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসেন সেসময়। তাই মুজিবের নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। এই সময়েই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং পত্র-বিনিময় ঘটে। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে শেখ মুজিব ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ফিরে এসে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করেন। ছাত্রলীগের সম্পাদক হন তিনি নিজে, মুসলিম লীগের সম্পাদক আরেকজন হলেও মূল কাজ তাকেই করতে হতো। মাদারীপুরেও মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় তারই প্রচেষ্টায়।
১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন, থাকেন বেকার হোস্টেলে, সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি নিয়ে। তখন লাহোর প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে, সুতরাং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে তার ধ্যানজ্ঞান। পাকিস্তান বলতে তিনি বোঝেন দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র—একটি পূর্বে, অন্যটি পশ্চিমে।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৪৩ (বাংলায় ১৩৫০) সালে বাংলায় দেখা দেয় ভয়াবহ মন্বন্তর। সরকারি হিসাবে ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়, বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা দাবি করা হয় ৩৫ লাখ।
দুস্থ মানুষের পাশে অদম্য মুজিব:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। অনেক মানুষ মারা যেতে থাকে। সোহরাওয়ার্দী তখন সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী। তিনি দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। গঠিত হয় সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট। ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলা হয়। এরপর সোহরাওয়ার্দী লঙ্গরখানা খোলার নির্দেশ দেন। মুজিব লেখাপড়া আপাতত বাদ দিয়ে দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার তত্ত্বাবধানে অনেক লঙ্গরখানা খোলা হয়। এখান থেকে দিনে একবার করে খাবার দেওয়া হতো। মুসলিম লীগ অফিস, কলকাতা মাদ্রাসাসহ অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। এ সময় শেখ মুজিবকে সার্বক্ষণিক পরিশ্রম করতে হতো। কোনোদিন হোস্টেলে গিয়ে ঘুমাতে পারতেন, আবার কোনোদিন মুসলিম লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে রাত কাটাতেন।
শুধু কলকাতাতে নয়, শেখ মুজিব রিলিফের কাজে গোপলগঞ্জেও যান। এখানেও সাধারণ মানুষের ওপর দুর্ভিক্ষের কঠিন থাবা পড়েছিল। না খেতে পেরে অধিকাংশ মানুষই কঙ্কালসার। এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব তার সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। এ বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য তার আত্মজীবনীর শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে।
তিনি লিখেছেন, ‘গোপালগঞ্জের মুসলমানরা ব্যবসায়ী এবং যথেষ্ট ধান হয় এখানে। খেয়ে-পরে মানুষ কোনোমতে চলতে পারত। অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিল, যদি একটা কনফারেন্স করা যায় আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতাদের আনা যায় তবে চোখে দেখলে এ তিন জেলার (যশোর, খুলনা, বরিশাল) লোকে কিছু বেশি সাহায্য পেতে পারে এবং লোকদের বাঁচানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আমাদের সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম। আলোচনা হলো। সব এলাকা থেকে কিছুসংখ্যক কর্মীকে আমন্ত্রণ করা হল। সভা আহ্বান করা হলো অভ্যর্থনা কমিটি করার জন্য। বয়স্ক নেতাদের থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে সেক্রেটারি করা হবে। প্রধান যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ রাজি হন না, কারণ খরচ অনেক হবে। দেশে দুর্ভিক্ষ, টাকা-পয়সা তুলতে পারা যাবে না। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে আমাকেই অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান এবং যশোর জেলার মৌলভী আফসার উদ্দিন মোল্লা নামে একজন বড় ব্যবসায়ীকে সম্পাদক করা হলো। …’ তিনি অক্লান্ত শ্রম দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানুষের প্রতি এমন ভালোবাসা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
খাজা নাজিমুদ্দিন তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৫ সালের মার্চে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা আস্থা হারিয়েছেন গণ্য করে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে হয় প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচন। বাংলায় মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। দেশভাগের আগে বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের (১৯৪৩) সময়ে ত্রাণকার্যে, প্রাদেশিক নির্বাচনের কালে প্রচারকার্যে এবং কলকাতার সেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিনগুলোতে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তরুণ মুজিব।
দুর্ভিক্ষের সময়ে শেখ মুজিব দিনভর লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন, রাতে কখনো হোস্টেলে ফিরে এসেছেন, কখনো মুসলিম লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। এরই মধ্যে ত্রাণকার্যে তিনি গোপালগঞ্জেও এসেছেন। নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদেরও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে, তিনি পিছু হটেননি। দাঙ্গার সময়ে মুসলমান ছাত্রীদের উদ্ধার করা, আহতদের শুশ্রূষার ব্যবস্থা করা, এলাকা পাহারা দেয়া—এমন বহুবিধ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়েছে। মুসলমানদের যেমন উদ্ধার করেছেন, তেমনি মুসলমান এলাকা থেকে হিন্দুদের উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছেন।
১৯৪৬ সালের এই দাঙ্গা শুধু কলকাতাতেই থেমে থাকেনি। ঢাকাতেও দাঙ্গা শুরু হয়। এরপর দাঙ্গা ছড়িয়ে যায় নোয়াখালীতে। হিন্দুদের বাড়িঘর লুট হতে থাকে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওদিকে ভারতের বিহার থেকেও দাঙ্গার খবর আসতে থাকে। সেখানে মুসলমানদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো হয়। লুটপাট হতে থাকে। আহত-নিহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এ সময় যেহেতু শেখ মুজিব কলকাতায় ছিলেন, তাই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করার জন্য তাকে বিহারে পাঠানো হয়। এখান থেকে শেখ মুজিব প্রায় এক হাজার অসহায় মানুষকে নিয়ে আসানসোলে যান। এখানে প্রায় দেড় মাস তিনি দুস্থ মানুষের পাশে থেকে কাজ করে গেছেন। প্রচুর পরিশ্রমের কারণে একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীরেই কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানে এসে জ্বর আরো বেড়ে গেল। খবর পেয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন।
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তখনো একেবারে থামেনি। একদিন ব্যারাকপুরে গোলমালের খবর পেয়ে সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হন। সেখানে মহাত্মা গান্ধীও আসেন। তারা প্রথম নারকেলডাঙ্গায় আসেন। এখানে যুক্ত হলেন মহাত্মা গান্ধী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী ও তার সেক্রেটারি এবং কয়েকজন কংগ্রেস নেতা। ইয়াকুব নামে শেখ মুজিবের এক ফটোগ্রাফার বন্ধু কলকাতা শহরে দাঙ্গার অনেক ছবি তুলেছেন। শেখ মুজিব ঠিক করলেন, এখান থেকে কয়েকটি ছবি মহাত্মা গান্ধীকে দেবেন। গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিব এই ছবিগুলো দিতে পেরেছিলেন।
তার কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত অনেক পরে নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন: সে-সময়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র অনেকদিন ধরে তাকে বিপদসংকুল এলাকা পার করে নিরাপদ অঞ্চলের সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে। পরে, বিহার দাঙ্গার সময়েও, তিনি এবং তার বন্ধুরা দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এবং বঙ্গীয় সরকারের সহযোগিতায় অনেক বাস্তুত্যাগী পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
যুদ্ধের শেষে ভারতে আসে ক্যাবিনেট মিশন। মুসলিম লীগ- কংগ্রেস দ্বন্দ্বের জেরে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট সূচনা হয় কলকাতার বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের। পরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে।
অবিভক্ত ভারতের বঙ্গীয় রাজনীতি:
এদিকে, ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির, বিশেষ করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার কমিউনিস্ট নেতাদের উদ্যোগে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে কৃষকদের মধ্য থেকেও এর নেতাদের আবির্ভাব ঘটে। উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত বাংলার ১৯টি জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রাদেশিক পরিষদে সরকার একটি বর্গা বিল আনে ১৯৪৭ সালে। তাতে আন্দোলন থেমে যায়, কিন্তু বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে বঙ্গ বিভাগ ঘটে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে অনেক জায়গায় নতুন করে তেভাগা আন্দোলন দেখা দেয়। এই আন্দোলন দমিত হলেও কৃষকরা এর থেকে কিছু সুবিধা পেয়েছিল।
এখন আমরা ফিরে যাচ্ছি শেখ মুজিবুর রহমানের কথায়। যেখানে তার প্রসঙ্গ থেমে গিয়েছিল, শুরু করতে হবে সেখান থেকে। কলকাতার প্রসঙ্গে।
কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে ওঠেন। ওই সময়কার, জনপ্রতিনিধিদের আচরণ সম্পর্কে তার এক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করার মতো। সন্দেহ করা হয়েছিল যে এমএলএ কেনাবেচা হচ্ছে। তখন তাদের ওপর নজরদারির দায়িত্ব শেখ মুজিব ও তার মতো আরো কয়েকজনের ওপর বর্তেছিল। এ বিষয়ে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন— ”একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হলো। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, ‘আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি, আমাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।’ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের! এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে আমাদের ধরে আনতে হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন।”
পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী পরিস্থিতি:
পরবর্তীতে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, সরাসরি বাংলা ভাষা আন্দোলনের দাবিতে রাজপথে নামেন মুজিব। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠন হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নইমউদ্দীন আহমদ হলেন তার আহ্বায়ক।
ফেব্রুয়ারি মাসেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যোগ দেয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১১ মার্চে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন সরকারি দফতরের সামনে পিকেটিং হয় এবং সেসব জায়গায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে, পরে কিছুসংখ্যক কর্মীকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর একটি চুক্তিস্বাক্ষর হলে চারদিন পর তিনি মুক্তি পান। ১৯ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর বক্তব্যের তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ যারা করেন, মুজিব ছিলেন তাদের একজন।
এরপর তাকে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতে। ফলে প্রথমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন, পরে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি জেলে থাকতেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় সরকারবিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। কারাবন্দি শেখ মুজিবকে তার যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। তিনি মুক্তি পান জুলাই মাসে, আবার গ্রেফতার হন ডিসেম্বরে। এবার প্রায় আড়াই বছরের কারাবাস। তার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
শেখ মুজিব লিখেছেন, সেই আন্দোলনের কিছু আগে বন্দি অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় আন্দোলন সম্পর্কে তিনি পরামর্শ দেন অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহাকে—তারা গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ফরিদপুর জেলে অনশন করতে শুরু করেন মুজিব।
১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেলের বাইরে থাকলে তিনি সারা প্রদেশ সফর করেছেন, জনসংযোগ করেছেন। তার সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল অসাধারণ। ফলে আওয়ামী লীগ দ্রুত জনসাধারণের মধ্যে স্থান করে নেয়, মুজিবও কর্মী থেকে নেতায় উপনীত হন।
১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা রাখার পক্ষে, দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিপক্ষে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার জন্য জোরালো বক্তব্য দেন। এ সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে যে মুসলিম শব্দ বর্জিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে যুক্ত নির্বাচন প্রথার সুপারিশ করে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার পেছনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে তার পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে বলে জানা যায়।
সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করে। এই সময়ে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি পেশ করেন। সরকার এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থা গ্রহণ করলে মুজিব ছয় দফা নিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বত্র জনসভা করে এর লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেন এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। এবছরই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাজউদ্দীন আহমদ হন দলের সাধারণ সম্পাদক।
মুজিবের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয় ১৯৬৮ সালে। শেখ মুজিবসহ মোট ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়। তবে জনগণ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে মুজিবের মুক্তির দাবিতে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে উত্তাল জনতা। এরপর শেখ মুজিবের দাবির মুখে ২৫ মার্চ জেনারেলে আইয়ুব খানকেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনকে শেখ মুজিব অভিহিত করেন ছয় দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে। নৌকা প্রতীক নিয়ে দুই পাকিস্তানের মোট ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। অবিসংবাদিত নেতা থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির পিতা। এরপর তার নির্দেশনায় ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে জন্ম লাভ করে নতুন একটি রাষ্ট্র।


বিজ্ঞাপন