নির্ধারিত সময়ের আগেই কর্ণফুলী টানেল

অর্থনীতি জাতীয়

নিজস্ব প্রতিনিধি : নির্ধারিত সময়ের আগেই কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ বা টানেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ নামের এই মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ করতে করোনার মধ্যে রাত-দিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল)।


বিজ্ঞাপন

প্রকল্পটি নির্ধারিত ৬০ মাসের আগেই শেষ হবে বলে ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন ঢাকায় চীনা দূতাবাসের ডেপুটি চীফ অব মিশন হ্যালং ইয়ান। পোস্টে চীনা সংবাদ সংস্থা সিএমজিতে বঙ্গবন্ধু টানেল নিয়ে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনও তিনি শেয়ার করেন।

ভিডিওটিতে সিসিসিসিএল-এর উপ ব্যবস্থাপক হুয়াং ইউয়ে ছুয়ানের সাক্ষাৎকারও রয়েছে। টানেল সম্পর্কে ছুয়ান বলেন, এখন পর্যন্ত টানেলের ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে এবং টানেল নির্মাণের সব সেগমেন্ট প্রস্তুত। দুই প্রান্তে ডায়াডেক্ট নির্মাণ, বোর্ড পাইল কনক্রিট পিয়ার, কলার বিমসহ বেশির ভাগ কাজ প্রায় শেষ। দুই পারে চলছে পিয়ার ক্যাপ ও ফেব্রিকেটেড বক্স গার্ডার নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ।

তিনি বলেন, ‘টানেলের ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে এবং চুক্তি অনুযায়ী ৬০ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও আমরা তার আগেই কাজ শেষ করতে চাই। আমরা এখন লক্ষ্যমাত্রা থেকে এগিয়ে আছি। টানেল খনন করতে আমরা শিল্ড মেশিন ব্যবহার করেছি। এই প্রকল্পের প্রধান সরঞ্জামই হলো এই শিল্ড মেশিন। এই যন্ত্র সম্পূর্ণ চীনা প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার করে কেবল কর্ণফুলী টানেলের জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।’

করোনায় প্রকল্পটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে সংশ্লিষ্ট সবার ঐকান্তিক চেষ্টায় অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে জানান ছুয়ান। তিনি বলেন, করোনায় কর্মীর সংখ্যা কমলেও এখন বেশির ভাগ বাংলাদেশি ও ৩০০ চীনা কর্মী ও প্রকৌশলী মিলে প্রায় ১০০০ কর্মী দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।

সিসিসিসিএল-এর উপ ব্যবস্থাপক বলেন, সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই কর্ণফুলি টানেলের নকশা ও উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষায়িত যন্ত্র দিয়েই তৈরি হচ্ছে এই টানেল। নদীর পানি বা কোনো রকম তরল পদার্থ যাতে টানেলে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি সেগমেন্ট নির্মাণ করা হচ্ছে অ্যান্টিসিপেস ম্যাটারিয়েল দিয়ে। ভেতরে বাতাস প্রবেশের জন্য থাকছে ২০টি শক্তিশালী পাখা। থাকবে পর্যাপ্ত আলো সরবরাহের ব্যবস্থা।

হুয়াং ইউয়ে ছুয়ান বলেন, ‘কর্ণফুলী টানেলের নকশার সময় আমরা উচ্চমান ও ক্ষমতার অ্যান্টি সিপেচ ডিজাইন করেছি। প্রথমে টানেলের টিউবগুলো উচ্চমানের অ্যান্টিসিপেচ উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, টিউবের বাইরে আমরা ক্রাউডিং ব্যবস্থা করেছি। যাতে বাইরে থেকে পানি আসবে না। তৃতীয়ত, আমরা টানলের নিচে পাম্পঘর রেখেছি, যাতে টানেলে পানি বা কোনো তরল ঢুকলে পাম্প করে দেয়া যায়।’

তিনি জানান, নির্মাণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হ্যান্ডবুক তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, যাতে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করতে পারেন তারা।

এই টানেল দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, পণ্য পরিবহনের ট্রাক, ভারি লরিসহ সব যানবহন চলাচল করতে পারবে বলে জানান হুয়াং ইউয়ে ছুয়ান।

বর্তমানে বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলেও কভিড সংক্রমণের শুরুর দিকে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প জটিলতায় পড়ে। শ্রমিক সংকটে ২০২০ সালের প্রথমার্ধে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি। মহামারির কারণে বিদেশি শ্রমিকদের আগমন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই সময় প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি কমে যায়। প্রকল্পটিতে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ জন দেশি শ্রমিক কাজ করলেও সাধারণ ছুটির সময় শ্রমিকের দৈনিক গড় সংখ্যা নেমে এসেছিল ২০০-২৫০-এ। প্রকল্পটিতে শুরুতে চীনা নাগরিক কর্মরত ছিলেন ২৯৩ জন। পরে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি লিমিটেড আরও ৮৭ জন চীনা নাগরিককে প্রকল্পের কাজে যুক্ত করতে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।

পরবর্তী সময়ে চীনে সেখানকার নাগরিকদের দেশে পৌঁছার পর ১৪ দিন করে দুই দফায় ২৮ দিনের কঠোর কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে চীনা কর্মীদের মধ্যেও এখন দেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। এসব কারণেই এখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও দ্রুতগতিতে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে।

২০১৫ সালে হাতে নেয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন রয়েছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া, ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে চীন সরকার।

দেশে প্রথমবারের মতো কোনো নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এই টানেলের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নামে। টানেল নির্মিত হলে দেশের জিডিপি শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযুক্ত সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজ।

২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে নির্বাচনী সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরই আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১২ সালে সেতু কর্তৃপক্ষ, সিসিসিসিএল ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে। এরপর ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের) সমঝোতা স্মারক সই হয়।

চীন সরকারই সিসিসিসিএলকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এ বিষয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসির মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।