বিধিনিষেধ শিথিলে সামনে মহাবিপদ!

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে টানা ১৫ দিন ধরে দুইশর ওপরে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমণও ঊর্ধ্বমুখী। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই। একটি আইসিইউ বেডের জন্য এখনই ৪০ জন গুরুতর করোনা রোগীকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তার ওপর এবার এসেছে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে সামনের দিনগুলোতে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, লকডাউন দিয়ে সীমিত সময়ের জন্য করোনা সংক্রমণ রোধ করা যায়। টিকা-গ্রহীতারাও নিরাপদ নন। টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর ভ্যাকসিনের কাজ শুরু হয়। তাই এখন স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পরতেই হবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাস্ক না পরলে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেছেন, লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। লকডাউন দেওয়ায় সংক্রমণ কিছুটা কমবে। তবে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর হলে সংক্রমণ আরো কমত। এখন জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা এবং সবাইকে টিকার আওতায় আনা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, শনাক্তের হার ও রোগী শনাক্তের সংখ্যা খুবই সামান্য হারে কমতে দেখা যাচ্ছে। তবে সংক্রমণ কমছে, সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাবে না; বরং দেশে করোনার সংক্রমণ এখনো বিপদসীমার অনেক ওপরে আছে। মৃত্যুর হার এখনো কমেনি। সংক্রমণ কমতে শুরু করলে তার এক সপ্তাহ পর মৃত্যু কমতে পারে।
সংক্রমণের এমন উচ্চঝুঁকির মধ্যেই আগামী বুধবার থেকে চলমান লকডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এরই মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আগামী বুধবার থেকে সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি অফিস, যানবাহন, বিপণিবিতান ও দোকানপাট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর শিল্পকারখানা ১ আগস্ট থেকেই খোলা রয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার বা বিনোদনকেন্দ্র খোলার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতিটি এলাকার প্রতিদিন মোট যানবাহনের অর্ধেক গাড়ি রাস্তায় নামানোর শর্ত দেওয়া হয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখতে হবে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেছেন, চলমান লকডাউন যেমনই হোক, সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। তবে ঠিকমতো লকডাউন বাস্তবায়িত হলে করোনা সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসত। এখন শনাক্তের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। এখন ব্যাপকভিত্তিক টিকা দিতে হবে। একই সঙ্গে সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শনাক্তের হার ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত মুখে মাস্ক পরতেই হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, যেহেতু লকডাউন ১১ আগস্ট শেষ হচ্ছে। তাই সংক্রমণ রোধ করতে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। আর ব্যাপক হারে গণটিকা দিতে হবে। দিনের পর দিন লকডাউন দিয়ে রাখা যায় না। দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তাই লকডাউন শিথিল হলেও সবাইকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, গত ২৪ জুলাই এর পর থেকে ০৯ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত প্রতিদিনই করোনায় মারা গেছেন দুইশর বেশি মানুষ। এই ১৫ দিনে মোট মারা গেছেন ৩ হাজার ৮৫১ জন। এর মধ্যে গত ২৫ জুলাই মারা যান ২২৮ জন; ২৬ জুলাই ২৪৭ জন; ২৭ জুলাই ২৫৮ জন; ২৮ জুলাই ২৩৭ জন; ২৯ জুলাই ২৩৯ জন; ৩০ জুলাই ২১২ জন; ৩১ জুলাই ২১৮ জন; ০১ আগস্ট ২৩১ জন; ০২ আগস্ট ২৪৬ জন; ০৩ আগস্ট ২৩৫ জন; ০৪ আগস্ট ২৪১ জন; ০৫ আগস্ট ২৬৪ জন; ০৬ আগস্ট ২৪৮ জন; ০৭ আগস্ট ২৬১ জন, ০৮ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত মারা গেছেন ২৪১ জন এবং গত একদিনে সারাদেশে আরও ২৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ২২ হাজার ৮৯৭ জন। একইসময়ে নতুন করে আরও ১১ হাজার ৪৬৩ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ১৫৮ জন।
সোমবার (৯ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১৪ হাজার ৪১২ জন। এ পর্যন্ত করোনামুক্ত হয়েছেন ১২ লাখ ১৯ হাজার ৮৫৯ জন।
গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে ডেল্টা : করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রমণশীল ডেল্টা ধরন কেবল শহর নয়, গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার এ ধরন ছাড়া অন্য ধরনগুলো এতো ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক ন্যাচারের চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার ডেল্টা ধরন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এর আগে শহরাঞ্চলে করোনার প্রকোপ বেশি হলেও গ্রামে এর তেমন প্রভাব পড়েনি।
প্রথমে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় ভারতে। এ কারণে ধরনটিকে করোনার ‘ভারতীয় ধরন’ও বলা হয়ে থাকে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গবেষণা চালিয়ে ন্যাচারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব স্থানে করোনার টিকা, পরীক্ষা বা স্বাস্থ্য সেবার ঘাটতি রয়েছে, গ্রামের সেসব স্থানগুলোতেই পৌঁছে যাচ্ছে ডেল্টা।
এ নিয়ে গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, করোনার আগের ধরন বা ভ্যারিয়েন্টগুলোকে এতো ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি।
কুইজন সিটিতে ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানী সিনথিয়া সালোমা, যিনি ফিলিপাইন জিনোম সেন্টারেরও প্রধান, বলেন, ‘(করোনার) ভ্যারিয়েন্টগুলো উদ্বেগের কারণ, বিশেষ করে ডেল্টা, যা ছড়িয়ে পড়েছে দূরবর্তী স্থানগুলোতেও; এটা সত্যিই স্বাস্থ্যসেবা খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।’
ভারতের গবেষকরা বলছেন, চলতি বছরে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে ভাইরাস শহর ছেড়ে ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় এমনটা দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ বলেন, ‘এ ধরনটি অনেক বেশি সংক্রমণশীল। এ কারণে স্বাস্থ্য সেবা পদ্ধতি এতোবেশি ব্যস্থ হয়ে উঠেছিল যে, প্রস্তুতি নেয়ার সময়ও পায়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের গ্রামাঞ্চলে দ্বিতীয় ঢেউ ছিল একেবারেই ধ্বংসাত্মক।’
বাংলাদেশেও করোনার ডেল্টা অন্য সবগুলো ধরনকে ‘দ্রত গতিতে’ অতিক্রম করেছে বলে লন্ডনভিত্তিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় যে, ভারত থেকে আসা লোকজনের মাধ্যমে এপ্রিলের শেষের দিকে ঢাকা ও দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় ডেল্টা ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা করোনার অন্য ধরনগুলোকে দ্রুতই ছাপিয়ে যায়।
রাজধানী ঢাকার শিশু স্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশনের অনুজীব গবেষক সেজুতি সাহা গ্রামাঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘একেবারে নতুন জনগোষ্ঠি আক্রান্ত হচ্ছেন, যারা এতোদিন যে কোনো কারণেই হোক সুরক্ষিত ছিলেন।’
সেজুতি সাহা জানান, আগে বাংলাদেশে করোনার যে বিস্তার দেখা গিয়েছিল, তা ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে সীমাবদ্ধ; যদিও শহরের লোকজন বার বার গ্রামে তাদের পরিবারের কাছেও গেছেন। তিনি বলেন, এটা নতুন যে গ্রামাঞ্চল ডেল্টার জন্য বাধা হচ্ছে না।


বিজ্ঞাপন