২১ আগস্ট ট্রাজেডি

এইমাত্র জাতীয় রাজধানী রাজনীতি

বিশেষ প্রতিবেদক : সৌম্য বিকেলে সেদিন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল ঢাকার রাজপথে। দিনের আলো যেন নিভে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই। ১৯৭৫ সালের কালো রাতের পর বাংলার ইতিহাসের এক কালো দিন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বাংলা বর্ষপরিক্রমায় ভাদ্র মাস। শরতের দিন যেমন হয়, সেই দিনটিও তেমনই হয়ত ছিল অন্য দশজনের জন্য। কিন্তু কারও কারও জন্য দিনটি একেবারেই ছিল অন্যরকম। সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশে বক্তৃতা করার কথা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। দিনভর প্রস্তুতি চলছিল তার। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। দুপুরের পর থেকে সমাবেশ স্থলে কর্মীদের আগমন ঘটতে থাকে। একটু পরই আসতে শুরু করেন দলীয় নেতারা। একটা ট্রাক জোগাড় করে বানানো হয়েছিল উন্মুক্ত মঞ্চ। প্রিয় নেত্রী এলেন। উঠলেন মঞ্চে। উপস্থিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য। তিনি বক্তৃতা শেষ করে আনতেই শুরু হলো গ্রেনেড হামলা।


বিজ্ঞাপন

বর্বর সেই হামলার কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে। অবশ্য শেখ হাসিনার ওপর এটাই প্রথম আক্রমণ নয়। এর আগেই একাধিকবার তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই একের পর এক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন তিনি। রাজনীতির কঠিন ব্রত সাধনা থেকে তাঁকে বিরত রাখতে না পেরে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম সরাসরি তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। লালদীঘি ময়দানে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে সেবারও প্রিয় নেত্রীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। সেদিন নিহত হয়েছিলেন ৭ নেতাকর্মী। আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো হামলা হয় তাঁর ওপর। ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সহায়তার ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনে মধ্যরাতে হামলা গুলিবর্ষণ করে। গ্রেনেড হামলা চালায়। প্রিয় নেত্রী তখন ওই বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ঘাতকদের অপচেষ্টা সেখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবার আক্রান্ত হন তিনি। উপনির্বাচনের ভোটের পরিস্থিতি দেখতে গ্রিনরোডের ভোটকেন্দ্রে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সন্ত্রাসীরা গুলিবর্ষণ ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। এরপর বছর তিনেকের থেমে থাকা। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আবার আক্রমণ করা হয় তাঁকে। নাটোর রেলস্টেশনে তাঁকে বহনকারী রেলগাড়ির কামরা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তখন বিরোধী দলের নেতা। ওই সমাবেশেও তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়। এরপর ১৯৯৬ সাল। সেদিন ছিল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্মারক বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সভামঞ্চ লক্ষ্য করে একটি মাইক্রোবাস থেকে গুলি চালানো হয়।


বিজ্ঞাপন

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরবর্তী ঘটনাটি এক ভয়াবহ চক্রান্ত। এই চক্রান্তের খবর প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালের ১২ জুলাই, দৈনিক জনকণ্ঠে। প্রকাশিত খবরে বলা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র-কন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ইমেইল চালাচালি হয়।

পরের বছর, অর্থাৎ ২০০০ সালের ২০ জুলাই শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর জনসভাস্থলের অদূরে হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থল।

২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ সেখানেও বোমা পুঁতে রাখে। উদ্দেশ্য গণতন্ত্রের মানসকন্যাকে হত্যা করা।

২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন তত্ত্ববাধায়ক সরকারের আমলে সিলেটে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চারায় স্থানীয় এক যুবদল নেতা। একইভাবে তাঁর গাড়ি বহরে হামলা হয় ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কলারোয়ায়। সে হামলাতেও তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোটের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল।

২০০৪ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রথম হামলাটি হয় ২ এপ্রিল, বরিশালের গৌরনদীতে। জামায়াত-বিএনপি ঘাতকচক্র তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে। এ বছরই সবচেয়ে বড় হামলাটি হয় ২১ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও বাংলদেশ আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৩ নেতাকর্মী ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। আহত হন আরও চার শ’ নেতাকর্মী। আহতদের অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকেই কাটাচ্ছেন যন্ত্রণাকাতর জীবন।

কেন বার বার এই হত্যাচেষ্টা? উত্তরও খুব সহজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক আদর্শ ধারণ করে।

ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের আদর্শে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার বিপক্ষে যাদের অবস্থান ছিল, তাদের ষড়যন্ত্রেই ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁকে হত্যা করলেও হত্যা করা যায়নি তাঁর আদর্শ। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তাঁরই আদর্শের পথ ধরে।

মুজিবাদর্শের বাংলাদেশ যারা চায় না, তারাই বার বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা কিংবা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা।

এর নেপথ্যে কাজ করেছে আদর্শ হত্যার চেষ্টা। বাংলাদেশকে প্রগতির পথ থেকে, মুজিবাদর্শের পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায় যারা, তারাই বার বার এই অপচেষ্টা করেছে। এ চেষ্টা যে তারা আরও করবে, এ আশঙ্কা আমাদের অমূলক নয়।