কোমায় থেকে না ফেরার দেশে ক্যাপ্টেন নওশাদ

জাতীয়

পাইলট নওশাদের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক 


বিজ্ঞাপন

ক্যাপ্টেন নওশাদের মৃত্যুতে বিমান প্রতিমন্ত্রীর শোক

বিশেষ প্রতিবেদক : পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন দুঃসাহসী অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউম। টানা ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় কোমায় থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এই পাইলট না ফেরার দেশে চলে গেলেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) কোমায় ছিলেন। তাঁকে ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়েছিল।
সোমবার স্থানীয় সময় ১০টা ৪৫ মিনিটে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে দেন ভারতের নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান।
এর আগে গত শুক্রবার সকালে ওমানের মাস্কাট থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে বিজি-০২২ ফ্লাইটটি নিয়ে ঢাকা আসার পথে ভারতের আকাশে থাকা অবস্থায় ক্যাপ্টেন নওশাদ অসুস্থ বোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কলকাতার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) কাছে ফ্লাইটটিকে জরুরি অবতরণের অনুরোধ জানান। একই সময় তিনি কো-পাইলটের কাছে ফ্লাইটের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন। কলকাতার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ফ্লাইটটিকে নিকটস্থ নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করার নির্দেশ দিলে কো-পাইলট ক্যাপ্টেন মুস্তাকিম ফ্লাইটটি অবতরণ করান।
বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজটির এই ফ্লাইটে ১২৪ জন যাত্রী ছিলেন। তারা সবাই নিরাপদে ছিলেন। শুক্রবারই আরেকটি ফ্লাইটে করে আট সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দল নাগপুরে যায়। ওইদিন মধ্যরাতের পর বিমানটিকে যাত্রীসহ ঢাকার বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়।
ফ্লাইটটি অবতরণের পর ক্যাপ্টেন নওশাদকে নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ২ দিন চিকিৎসার পর অবস্থার অবনতি হলে রোববার তাকে হাসপাতালের সার্জিক্যাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এসআইসিইউ) কোমায় নেওয়া হয়। সেখানে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। হার্ট অ্যাটাকের পর তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় বলে জানান হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
রোববার রাতে নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালে যান ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউমের দুই বোন। তারা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন নওশাদের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে মত দেন।
নওশাদ ও তার ফার্স্ট অফিসারের কারণে এবার জীবন রক্ষা পেয়েছে ওমান থেকে ঢাকার উদ্দেশে আসা ১২৪ যাত্রীর। তবে এটিই প্রথম নয়, পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালে আরেকটি দুর্ঘটনার হাত থেকে ১৪৯ যাত্রী আর সাত ক্রু’র জীবন বাঁচিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ।
২০১৭ সালে ক্যাপ্টেন নওশাদকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রশংসাপত্র পাঠায় আন্তর্জাতিক পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ক্যাপ্টেন রন অ্যাবেল।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শনিবার রাতেই নওশাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিনি কোমায় চলে যান। রোববার দুপুরে নওশাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিমানের বেশ কয়েকটি অসমর্থিত সূত্র তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওশাদের মৃত্যুর ঘোষণা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেয়নি।
ক্যাপ্টেন নওশাদ ক্লিনিক্যালি ডেড হলেও স্বজনরা লাইফ সাপোর্ট খুলে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন তারা। এরপর সোমবার চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান ক্যাপ্টেন নওশাদ।
জানা গেছে, ক্যাপ্টেন নওশাদ ছিলেন একজন দক্ষ বৈমানিক। তাঁর দক্ষতায় ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর বেঁচেছিল যাত্রী, ক্রুসহ ১৫০ মানুষের প্রাণ। ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ক্যাপ্টেন নওশাদকে নিয়ে ছুটির দিনেতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি এখানে পুনঃপ্রকাশ হলো।
যাত্রী ১৪৯ জন। ক্যাপ্টেন (প্রধান পাইলট), ফার্স্ট অফিসার (পাইলট) আর পাঁচজন কেবিন ক্রু। দিনটি ছিল ২২ ডিসেম্বর। ওমানের স্থানীয় সময় তখন রাত তিনটা। গভীর রাতে দেড় শতাধিক আরোহী নিয়ে মাসকট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গর্জন করে আকাশে উড়াল দিতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ। গন্তব্য ছিল চট্টগ্রাম। কিন্তু মাসকট বিমানবন্দরে রানওয়ে থেকে উড়াল দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে উড়োজাহাজটিতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। মাইক্রোফোনে যাত্রীদের আতঙ্কিত না হতে বলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুম। তিনি ও ফার্স্ট অফিসার মেহেদী হাসান বুঝতেও পারছিলেন, কী ঘটেছে। ১৮ টন জ্বালানি আর উড়োজাহাজটির ওজন ৬০ টন। সব মিলিয়ে ৭৮ টন ওজনের বিশাল উড়োজাহাজের ওমানে জরুরি অবতরণ করাও অসম্ভব। একটু এদিক-সেদিক হলেই বিস্ফোরিত হতো উড়োজাহাজটি। প্রাণ যেতে পারত সব আরোহীর। তবে পাঁচ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করান ক্যাপ্টেন নওশাদ। জীবন রক্ষা পায় দেড় শ’ যাত্রীর।
দুঃসহ অভিযাত্রার স্বীকৃতিও মিলেছে ক্যাপ্টেন নওশাদের। বৈমানিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএএলপিএ) প্রশংসাপত্র পেয়েছেন ৪০ বছর বয়সী এই বৈমানিক। কানাডার মনট্রিলে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে বৈমানিকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী মে মাসে। ক্যাপ্টেন নওশাদ সেখানে এই দুঃসহ যাত্রার বর্ণনা দেওয়ার কথা ছিল।

পাইলট নওশাদের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ কাইয়ুমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এর আগে ২৭ আগস্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ওমানের মাসকাট থেকে ঢাকায় ফিরছিল। পথে বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ কাইয়ুম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিমানের সেকেন্ড পাইলট তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের নাগপুরে জরুরিভিত্তিতে বিমানটি অবতরণ করান। ওই ফ্লাইটে ১২৪ জন যাত্রী ছিলেন।
পরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া পাইলট নওশাদ কাইয়ুমকে নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন সোমবার মারা যান তিনি।

ক্যাপ্টেন নওশাদের মৃত্যুতে বিমান প্রতিমন্ত্রীর শোক : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী এমপি ও সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন।
সোমবার পৃথক শোক বার্তায় তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বিমান প্রতিমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেন, ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউম ছিলেন একজন দক্ষ পাইলট। তিনি দায়িত্বপালনকালে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার মতো একজন অভিজ্ঞ পাইলটের মৃত্যুতে বিমান দীর্ঘদিন শূন্যতা অনুভব করবে।
বিমানসচিব তার শোকবার্তায় বলেন, ক্যাপ্টেন নওশাদের মতো দক্ষ পাইলট একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। দক্ষতার জন্য আন্তর্জাতিক পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। তার মতো একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ পাইলটের মৃত্যু প্রতিষ্ঠানের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
ওমানের রাজধানী মাস্কাট থেকে গত ২৭ আগস্ট ১২৪ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে মধ্য আকাশে হঠাৎ অসুস্থতা অনুভব করেন ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউম। পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের শিডিউল ফ্লাইটটি (বিজি ০২২) ভারতের নাগপুরের ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। সেখান থেকে খুব দ্রুত তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা চলাকালে সোমবার সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।