১৪ দলীয় জোটে টানাপড়েন

এইমাত্র জাতীয় রাজনীতি

*আ’লীগ বলছে জোট অটুট
*শরিকরা বলছে অকার্যকর

 

বিশেষ প্রতিবেদক : ২০০৪ সালের শেষদিকে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের বিরুদ্ধে ২৩ দফার ভিত্তিতে গঠিত জোটের নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। আদর্শিক এই জোট ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে একসঙ্গে অংশ নেয়। দুই দফায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায়ও রাখা হয় জোট নেতাদের। সর্বশেষ জোট নেতাদের বাইরে রেখে সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ, জাসদ-ইনু, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং বাম জোট ১১ দল মিলে এ জোট গঠন হয়। ১১ দলে আছে-সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, বাসদ (খালেকুজ্জামান), বাসদ (মাহবুব), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল।
এদের মধ্যে সিপিবি, বাসদ, (খালেকুজ্জামান) ও নির্মল সেনের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল শুরু থেকে ১১ দলের সঙ্গে থাকলেও ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি। গণফোরামও জোট থেকে বেরিয়ে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তারা।
এদিকে বাসদ (মাহবুব) জোটের শুরু থেকেই নিষ্ক্রিয় ছিল। দলটির প্রধান নেতা আ ফ ম মাহবুবুল হক ২০০৪ সাল থেকে কানাডায় চলে গেলে দলের কার্যক্রমও সীমিত হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে কানাডায় মারা যান মাহাবুবুল হক। এ সময়ে একাধিক খ-ে ভাগ হয় দলটি। বর্তমানে রেজাউর রশীদের নেতৃত্বে বাসদের একটি অংশ ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তরিকত ফেডারেশন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি) ১৪ দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। অপরদিকে জাসদ ইনু ভেঙে বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া) গঠন হয়। বর্তমানে জাসদের দুই অংশই ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে একসঙ্গে ভোট করলেও ক্ষমতার অংশীদার করা হয়নি। এরপর ১৪ দলের শরিক দলগুলোর ভেতর দূরত্ব বেড়ে যায়।
আওয়ামী লীগ নেতারা এই দূরত্বকে ক্ষমতার অংশীদার থাকা না থাকার দূরত্ব বলে মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজি জাফরউল্যাহ বলেন, এই দূরত্ব মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রীক।
জোটের শরিক নেতাদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক কোনও যোগাযোগ নেই বললেই চলে। করোনা মহামারি মোকাবেলায়ও জোটগত কোনও কর্মকা- নেই। মোটকথা ভালোমন্দ কিছুতেই যোগাযোগ হয় না। অথচ আগে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
শরিক নেতারা বলেন, দূরত্ব এমন পর্যায়ে গেছে যে, ঈদ, পূজা-পার্বণে সামান্য শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয় না।
তাদের দাবি, ১৪ দল এখন অতীত। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা অকার্যকর।
তবে আওয়ামী লীগ বলছে জোটে দূরত্ব নেই। রাজনৈতিক কর্মকা- নেই বলেই মনে হচ্ছে দূরত্ব আছে। জোটের সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, জোট অটুট আছে।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ১৪ দলীয় জোট হয়েছে, সেসব পূরণে আরও সময় দরকার। তাই জোট সক্রিয় রাখাই বাঞ্ছনীয়। এ জন্য আওয়ামী লীগকে আরও সক্রিয় হওয়া উচিত। জোট নেতাদের ভেতর মনোমালিন্য রয়েছে। আলোচনা করে এর সমাধান করা উচিত।’
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘আন্দোলনের সময় জোটের দরকার হয় বেশি। তখন ছোট-বড় দলের প্রশ্ন আসে না। জোটের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।’
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জোটের কর্মকা- এখন ইস্যুভিত্তিক ভার্চুয়াল আলোচনায় সীমাবদ্ধ। ২৩ দফার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনও নজর নেই। এখন হয়তো আওয়ামী লীগ ভাবছে বাকিটা পথ তারা একাই এগোবে।’
কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহবায়ক অসীত বরণ রায় বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। তাই ১৪ দলের প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়নি।
গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ জাসদের দলীয় এক অনুষ্ঠানে দলটির সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, ‘আমরা ১৪ দলের কোনো কর্মসূচিতে যাই না। তবে এখনো জোট থেকে বের হয়ে যাইনি।’
জোটে দলটির অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই যাই না (কর্মসূচিতে)। ১৪ দল তো এখন শুধু দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করে থাকে। অন্য কোনো ইস্যুতে তেমন আলাপ নেই। আওয়ামী লীগ যদি আলাপ না করতে চায়, তাহলে আমরা তো তাদের বাধ্য করতে পারব না। শুরুতে ১৪ দলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। জোটটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেরেছে। এখন আর সে অবস্থা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বর্তমান সময়ের কর্মকা- জোটের হারমনির (ছন্দ) সঙ্গে যায় না। তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে মগ্ন। সেক্যুলার রাজনীতি করার যে কষ্ট তা তারা করতে চায় না। এটা বঙ্গবন্ধু করেছেন। তিনি গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিজেদের মতাদর্শের পক্ষে পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু এখনকার আওয়ামী লীগ তা চায় না। তারা চায় নানা সমীকরণ মিলিয়ে ক্ষমতায় থাকতে। তারা চায় নানা কিছু দখল করতে। কিন্তু মানুষকে পরিবর্তন করে নিজেদের পক্ষে আনার দিকে তারা নেই।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই বছরই ২৩ দফা ঘোষণা দিয়ে ১৪ দলীয় জোটের যাত্রা শুরু হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। কিন্তু জোট গঠনের পরপরই ১১ দল থেকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সহ কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। কিন্তু জোটটি ১৪ দল নামেই বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে ২০০৭ সালের এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জোটের শরিক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ১৪ দল ছেড়ে না গেলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার প্রায় ১৩ বছরে আর কোনো দল আওয়ামী লীগের জোট ছেড়ে যায়নি। বরং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভা-ারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন জোটে যোগ দেয়। এখন যদি বাংলাদেশ জাসদ বেরিয়ে যায়, তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে এই প্রথম জোটটিতে ভাঙন দেখা যাবে।
জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সঙ্গেও বেশ টানাপড়েন চলছে আওয়ামী লীগের। গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এক আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু ও কর্নেল তাহের বাংলাদেশ বেতারে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে এ হত্যাকা-ে তাঁদেরও দায় আছে মন্তব্য করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাও বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের দায় আছে বলে মন্তব্য করেন।
আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকে নেতিবাচক সমালোচনা শুনে ক্ষুব্ধ জাসদের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁরাও পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছেন। শেখ সেলিমের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতি দেয় জাসদ। দলটির দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জাসদকে যুক্ত করে বক্তব্য প্রদানকারী শেখ সেলিম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর আপন মামা বঙ্গবন্ধু ও আপন ভাই শেখ মনির লাশ ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে যুক্ত তৎকালীন আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে কী করেছিলেন, তা জাতি জানতে চায়।’
সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগ ও জাসদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য জোটের মধ্যে অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ। দিবসভিত্তিক ভার্চুয়াল সভা-সেমিনার আয়োজন ছাড়া কার্যত নিষ্ক্রিয় ১৪ দলের এই দুই শরিকের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বাড়তে থাকলে তার পরিণতি হতে পারে জোট ভাঙন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাসদের একজন নেতা বলেন, স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগ সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে জাসদকে সম্পৃক্ত করতে চাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা তো আওয়ামী লীগের নেতাদের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যান না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা এগুলো করতে চাইলে তা জোটের জন্য ক্ষতিকর হবে।


বিজ্ঞাপন