করোনাকালে ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস

উপ-সম্পাদকীয়/মতামত

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
করোনাকালে আজ বুধবার ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস.২০২১। ১৯৬৫ সালের ৮-১৯ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কোর উদ্যোগে ইরানের তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো প্রথম দিবসটি উদযাপন করলেও স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার সাক্ষরতা বিস্তারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে। সবার জন্য শিক্ষা এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্যসমূহ অর্জনে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব পাঁচ বছর মেয়াদী গ্লোবাল এডুকেশন ফার্স্ট ইনিশিয়েটিভ (জিইএফআই) চালু করেন। এ উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সারাবিশ্বের ১৪টি দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ সাফল্যের ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে ইউনেস্কো মহাসচিব , মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তি বৃক্ষ’ পদক প্রদান করেন।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ তাঁর কলামে লিখেন…
পৃথিবীতে বর্তমানে আনুমানিক ৭হাজার ৯৭টি ভাষা বেঁচে আছে। এর মধ্যে দুই হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা এক হাজারেরও কম। এ ছাড়া মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের আছে লিখিত রূপ। এসব ভাষায় ব্যবহার করা হয় ৪৬ ধরনের বর্ণমালা। বাকিগুলো মৌখিকভাবেই চর্চিত হয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাকেন্দ্রিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। সেগুলোর অবস্থান কোথায় আছে সেগুলোকেও বুঝতে হবে।বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ও ডিজিটালাইজড বিশ্বে বহুভাষিকতার বৈশিষ্টাবলি, রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর প্রভাব ও ফল কী হতে পারে বহুভাষিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্যসব ভাষার অন্তর্ভুক্তি ঘটানোও সাক্ষরতা দিবসের উল্লেখযোগ্য একটি দিক। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীতে ৭৭৫ মিলিয়ন মানুষ সাক্ষরতার মৌলিক ধারণা থেকে দূরে রয়েছে। এর অর্থ হচেছ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয়। এই ২০ শতাংশের মধ্যে আবার প্রায় ৬৬ শতাংশ হচেছ নারী। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন শিশু এখনও হয় বিদ্যালয়ে যায়নি কিংবা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে।সাক্ষরতার সঙ্গে উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এদেশে সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৩.৯ শতাংশ এবং আমাদের মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার। তবে শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নদের সাক্ষর বলা হয় না, এর সঙ্গে জীবনধারণ, যোগাযোগ দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের দক্ষতাও যুক্ত হয়েছে। একসময় ছিল যখন কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। বর্তমানে যিনি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোটো বাক্য পড়তে পারবেন, সহজ ও ছোটো বাক্য লিখতে পারবেন এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাবনিকাশ করতে পারবেন তাকে আমরা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলব। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো একে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে।যেসব শ্রমিক পরিবহনের সঙ্গে সংযুক্ত তাদের সাক্ষরতা বলতে আমরা কী বুঝব? তারা অবশ্যই নিজের নাম লিখতে পারবে, পরিবহন সম্পর্কিত আদেশ নিষেধ নিজ ভাষায় পড়তে পারবে, জনসাধারণ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হবে। যেমন অযথা হর্ন বাজানো, হাইড্রোলিক হর্ন না বাজানো, কোথায় কোথায় হর্ন একেবারেই বাজানো যাবে না ইত্যাদি। একইভাবে, কৃষিশ্রমিকদের ফসল উৎপাদনের সাধারণ নিয়মকানুন লেখা বই পড়া ও বুঝতে পারা, শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তার শিক্ষার পূর্ণ অধিকার সম্পর্কে জানা ও আদায় করা, তাদের জন্য কোন কাজগুলো ঝুঁকিপূর্ণ তা বুঝতে পারা সাক্ষরতার অংশ। জনগণকে তাদের পেশা অনুযায়ী সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তুলবে, সরকার সেখানে সহায়তা প্রদান করবে, সামর্থ্য অনুযায়ী বেসরকারি সংস্থাসমূহ সহায়তা করবে। এভাবেই দেশ ও বিশ্ব থেকে প্রকৃত নিরক্ষরতা দূর হবে, প্রয়োজনীয় সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি হবে।বিশ্বে পনেরো বা তার বেশি বয়সিদের সাক্ষরতার হার ৮৬.৩ শতাংশ, তার মধ্যে পুরুষ ৯০ শতাংশ এবং নারী ৮২.৭ শতাংশ। ২০০৬ সালে ইউনেস্কোর গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিম আফ্রিকায় সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম। বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে কম সাক্ষরতাসম্পন্ন তার মধ্যে রয়েছে বার্কিনা ফাসো (১২.৮ শতাংশ), নাউজার ১৪.৪ শতাংশ, এবং মালি ১৯ শতাংশ। ২০১৫ সালে এই হার কিছুটা বেড়েছে সাব সহারান আফ্রিকায় ৬৪ শতাংশ। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাক্ষরতা দশক ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে এর সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা যুক্ত করে ‘সাক্ষরতা এবং স্বাস্থ্য’ হিসেবে তা পালিত হয়েছিল। ২০১১-১২ সালে এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সাক্ষরতা ও শান্তি’।১৯১৮ সালে আমাদের দেশে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৩৪ সালে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৬০ সালের ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় সফলভাবে পরিচালিত হয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যুরো অব নন ফরমাল এডুকেশন’। ১৯৯১ সালে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হচেছ আর মেয়েদের শিক্ষা বৃত্তি তো আছেই। আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচেছদে ছয় থেকে দশ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বিনামূল্যে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো সাক্ষরতা বৃদ্ধির ইতিবাচক পদক্ষেপ।বর্তমান বিশ্বে এখনও ৭৭৫ মিলিয়ন মানুষ সাক্ষর নয়, প্রতি পাঁচজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন নিরক্ষর। এ এক বিশাল বিভাজন নয় কি? এই বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৪ শতাংশই আবার নারী। বিশ্বের সাত কোটি শিশু এখন লিখতে ও পড়তে পারে না। বিশ্বের মোট অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তিন-চতুর্থাংশই বাস করছে জনবহুল ১৫টি দেশে। আফ্রিকার অনেক দেশগুলোতে আমরা অনবরত সংঘাত, অস্থিতিশীলতা দেখতে পাই, ঐসব দেশগুলোতে সাক্ষরতার হারও কিন্তু অনেক কম অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ অবস্থা ও উন্নয়ন সূচকের সঙ্গে সাক্ষরতার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার যখন (১৯৯১ সাল) ৩৫.৩ শতাংশ ছিল তখন ‘সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম (ইনফেপ)’ নামে একটি বড়ো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৫৯.৮২ শতাংশ। বর্তমানে ৭৩.৯ শতাংশ।সাক্ষরতাকে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং মানব উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ধরা হয়। কারণ দারিদ্র্য হ্রাস, শিশুমৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি জরুরি। সাক্ষরতার পরিবর্তিত সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের অবস্থান কোথায় স্ট্যান্ডর্ড মানদণ্ডে সেটি পরিমাপ করতে হবে, শুধুমাত্র সংখ্যার বৃদ্ধিতে উন্নীত করে তৃপ্তি পাবার অবকাশ নেই।আর বর্তমান যুগের সাথে তিনি তাল মেলাতে পারছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তিনি পারছেন না, কাজেই সাক্ষরতার সংজ্ঞা পাল্টে যাবে। আমাদের জীবন পাল্টে গেছে, শিক্ষাদানের বা শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতিও অনেকটাই পাল্টে গেছে। আরও একটি বিষয় এখানে চলে আসে, সেটি হচ্ছে বৈশ্বিক এই প্রেক্ষাপটে শুধু নিজের দেশের ভাষায় যদি একজন লোক সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হন, তাতে কিন্তু গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক হিসেবে প্রকৃতঅর্থে তিনি সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নন। কারণ যেসব প্রয়োজনীয় তথ্য একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক, সেটি স্বাস্থ্যসম্পর্কিতই হোক আর নিরাপত্তা সম্পর্কিতই হোক, তাকে কিন্তু জানতে হচ্ছে। আর সেটি জানার জন্য একটি বৈশ্বিক ভাষার সাথে পরিচিত তাকে হতে হচ্ছে। যেমন, এখন ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে যা কিছু শেয়ার করা হয়, সেই সাক্ষরতা কিন্তু ইংরেজিতেই করতে হয়। শুধু বাংলায় করলে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী কিংবা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কাজেই সাক্ষরতার সংজ্ঞা এখন ব্যাপক ও বিস্তৃত হতে বাধ্য।সাক্ষরতা সমাজে শান্তি স্থাপনে অবদান রাখে, মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে। এর সাথে এখন যুক্ত হচ্ছে সাক্ষরতার মাধ্যমে গোট পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার দক্ষতাটিও। কোথায় কোভিডের উৎপত্তি হলো, কীভাবে তা দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়ালো, কীভাবে মানুষ আক্রান্ত হয়, কীভাবে এ থেকে নিজেকে, পরিবারকে রক্ষা করা যায়, এ সবই আমরা জানতে পারছি অনলাইনে। যেসব ডিভাইস আমাদের অনলাইনে যুক্ত করছে সেগুলোর সাথে পরিচয়, সেগুলোর ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গোটা পৃথিবীতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত । তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ।বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। ১৩ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি অন্তত একটি সামাজিক যোগাযোগ প্রোফাইল রয়েছে। তারা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিশু-কিশোর, গৃহিনী, পেশাজীবী এদের বেশিরভাগেরই এখন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
২০১৭সালের এপ্রিল মাসের জরিপ অনুযায়ী ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছে । বিশ্বব্যাপী ইউটিউব ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ১৫০ কোটি, হোয়াটসঅ্যাপ ১২০ কোটি, ফেসবুক মেসেঞ্জার ১২০ কোটি ও উইচ্যাট ব্যবহারকারী ৯৩ কোটি ৮০ লাখ। আমরা ফেসবুক ব্যবহার করছি কেন? এর উত্তর খুব সহজ। অলস দেহে সোফায় বসে কিংবা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শীতের রাতে কাঁথাকম্বলের মধ্যে লুকিয়ে ফেসবুকে চাপ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার কোন বন্ধু কী করছেন, সেখানকার আবহাওয়া, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আমেরিকায় রাস্তায় কী হচ্ছে ইত্যাদি থেকে শুরু করে দেশের কোন জেলায় কী হচ্ছে, রাজধানীর কোন এলাকায় কী হচ্ছে, কোন সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে কেন পড়েছে, কীভাবে ধরা পড়েছে, কোন আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবের কী কী সুসংবাদ এসেছে, কী কী দুঃসংবাদ হলো সবই এখন হাতের মুঠোয় দেখতে ফেসবুকের কল্যাণে।এ বিষয়গুলোকে সাক্ষরতার অবিচ্ছেদ্য অংশ ধরে নিলে সাক্ষরতার হার কত হবে, সে হিসেব নিশ্চয়ই আমাদের কোথাও সেভাবে নেই। প্রচলিত অর্থে দেশে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ২৫ লাখ। তার অর্থ দাঁড়ায়, শতভাগ সাক্ষরতা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছি। প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী বৈশ্বিক হিসেবে এখনও ২৬ কোটির বেশি শিশু-কিশোর স্কুলে যায় না এবং প্রায় ৬২ কোটি মানুষ সাক্ষরতা ও হিসাব-নিকাশে ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। অথচ বিশ্বে প্রতিবছর কত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয় মারণাস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে। আর দুবাইয়ের বাসিন্দা যাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন কোটিপতি। তারা বিলাসী জীবনের পাশাপাশি বন্য হিংস্র জন্ত-জানোয়ার নিজেদের দশ কোটি থেকে একশত কোটি টাকা দামের গাড়িতে নিয়ে বেড়ায়, নিজেদের ড্রইংরুমে বাঘ, ভল্লূক আর শিম্পাজী পুষে। অথচ কোটি কোটি শিশু শুধু দারিদ্রের কারণে এখনও নিজ নিজ দেশের বর্ণমালার সাথেই পরিচিত নয়।এই বৈপরীত্য মোকাবিলা করার মতো নেতৃত্ব বিশ্বে প্রয়োজন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা রয়েছে চার নম্বরে। এখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষ ও মানস্মত শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কাজটি সহজে হয়ে যেতে পারে। ১৯৯১ সালে সাক্ষরতার হার ছিলো ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময় দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম বা ইনফেপ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।তারপর ২০০১ সালে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পটি ২০১৪ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষরতা লাভ করানো এর উদ্দেশ্য। তবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭
তার ধারাবাহিকতায় গত বছরের চেয়ে এ হার আরও প্রায় ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৭ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সেকেন্ড চান্স হিসেবে দশ লাখ শিশুকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেখানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালে পাইলটিং হিসেবে ছয় উপজেলার এক লাখ শিশুকে এর আওতায় আনা হয়েছে। পরবর্তীতে ২৫০ উপজেলা ও ১৫টি শহরে পর্যায়ক্রমে আরও ৯ লাখ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। এগুলো সবই শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের প্রচেষ্টারই অংশ।
করোনাকালে বিশ্বের ১৮৫টি দেশের ১৫৪ কোটি ২৪ লাখ ১২ হাজার শিক্ষার্থী বিদ্যালযে যেতে পারছে না। তাদের জীবনে এর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। এর মধ্যে চীনে সবচেয়ে বেশি শিশু-কিশোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওই তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চীনে ২৩ কোটি ৩০ লাখ এবং বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। বাংলাদেশে ২০২০ সালে ১৭ মার্চ থেকে সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার নতুন করে শুরু হবে ১২ সেপ্টেম্বর ২১ ইং থেকে।গত বছর থেকে শুরু হয়েছে ভার্চুয়াল ক্লাস অর্থাৎ বিকল্প উপায়ে পাঠদান; যদিও এটি কোনোভাবেই সরাসারি পাঠদানের বিকল্প নয়।আবার
বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা গত বছর ছিলো ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ।আর সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাক্ষরতার হার বাড়লেও দেশের মোট জনসমষ্টির ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর রয়েছেন। এ ছাড়া ২০১০ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। সে হিসেবে গত এক দশকে সাক্ষরতার হার ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
★আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে ইসলামী দৃষ্টিকোণঃ- এ জন্য যে কোনো বয়সের প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য জ্ঞান অর্জন আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়, ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর।’ সুতরাং বোঝা গেল শিক্ষার কোনো বয়স নেই, যে কোনো বয়সের লোকের জন্যই জ্ঞানার্জন আবশ্যক।আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সর্বপ্রথম ওহি ছিল শিক্ষাবিষয়ক। তাই তো বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পড়ার প্রতি আদিষ্ট হয়েছিলেন। তার ওপর নাজিল হলো ঐশীবাণী- ‘(হে নবি!) আপনি পড়ুন! প্রতিপালকের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক্ব)শুধু বিশ্বনবির ক্ষেত্রেই নয়, বরং আল্লাহ তাআলা হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে সব নবি এবং রাসুলদেরকে জ্ঞান বা শিক্ষার সঙ্গেই যুক্ত রেখেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবি! আমি আপনাকে এমন সব জ্ঞান (শিক্ষা) দান করেছি; যা আপনিও জানতেন না এবং আপনার পূর্বপুরুষও জানতো না।’ (সুরা আন’আম: আয়াত ৯২)রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বা সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করেননি। তিনি দুনিয়ারর মানুষকে উত্তম চরিত্র ও আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলতে এবং শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে ঘোষণা করেছিলেন- ‘নিশ্চয়ই আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘আমি মানুষকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতেই প্রেরিত হয়েছি।’বিশ্বনবি সুশিক্ষিত জাতি গঠনে সমগ্র মানবজাতির সামনে শিক্ষার মৌলিক নীতিমালা পেশ করেছেন। তিনি নবুয়ত লাভের পর পবিত্র নগরী মক্কার সাফা পাহাড়ের সন্নিকটে ‘দারুল আকরাম’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শিক্ষালয়।মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের পর বিশ্বনবি মসজিদে নববিতে তাঁর শিক্ষার কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। যা আজও অব্যাহত রায়েছে। বিশেষ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মসজিদেই বাদ আসর নিয়মিত শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকতেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর নিকটে থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে মসজিদে নববিতে বসে থাকতেন। এমনকি নারীদের জন্য তিনি আলাদাভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।বিশ্বনবির দুনিয়ার জীবনে মদিনা মুনাওয়ারায় ৯টি মসজিদ ছিল। প্রত্যেক মসজিদেই এলাকাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। যেখানে সব সময় কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি হাদিস ও দুনিয়াবি প্রয়োজনীয় অন্যান্য কল্যাণমুখী শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।এক কথায়, নিরক্ষরতা মুক্ত সমাজ গঠনে বিশ্বনবির ভূমিকা ছিল অসপরিসীম। যেখানে কোনো বর্ণ-বৈষম্য ভেদাভেদ ছিল না। আরব-অনারব, ক্ষমতাশালী-নিরীহ, ধনী-গরিব সবাই সমভাবে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেতো। এমনকি বিশ্বনবির শিক্ষানীতির যুগোপযোগী অনুষঙ্গ ছিল অমুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে অসংখ্য ইয়াহুদি ও অমুসলিমের শিক্ষা গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়।বর্তমান সময়ে মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রমও নবুয়তি যুগের শিক্ষার একটি প্রচলিত ধারা। যেখানে কোমলমতি শিশু-কিশোররা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নিজস্ব ভাষা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে সহজেই। যা আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোক্তাদের প্রশংসনীয় উদ্যোগও বটে।পরিশেষে দীর্ঘ দুই বছর যাবৎ করোনা মহামারীর কারণে পড়ালেখা ছিলো নিস্তব্ধ আর নতুন করে আমাদের প্রত্যাশার ডালপালা অনেক। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে হোক। শিক্ষা হোক জীবনের জন্য। সাক্ষরতা বয়ে আনুক সবার জন্য অনুপম সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির সুবাতাস। সাক্ষরতাকে হাতিয়ার করে দুনিয়ার সব মানুষের জীবন হয়ে উঠুক অনাবিল প্রশান্তির ঠিকানা। শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌহার্দ্যের এ পৃথিবীতে মানুষের জন্য আর কোনো দ্বন্ধ সংঘাত কাম্য নয়। বিশ্বের বুক থেকে ক্ষুধা, দরিদ্রতা ও দুর্নীতি চিরতরে নিপাত যাক। ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষের জন্য কলম, কাগজ আর বই হোক দুর্দিনের হাতিয়ার। সাক্ষরতা হোক দক্ষ হয়ে জীবন তৈরি ও আগামির ডিজিটাল বিশ্ব গড়ে তোলার দুর্বার ও দুর্জেয় হাতিয়ার ।


বিজ্ঞাপন

লেখক : স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কার্যনির্বাহী পরিষদ, কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি।