মেগা প্রকল্প মেগা দুর্ভোগ

এইমাত্র জাতীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক : মেট্রোরেল ও বিআরটিসহ কয়েকটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে যে ভয়াবহ জনদুর্ভোগ চলছে কয়েক বছর ধরে তা থেকে আপাতত মুক্তি মিলছে না নাগরিকদের।
এ দিকে উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুরের পল্লবী পর্যন্ত প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচলের উদ্বোধন করে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী বছর নাগাদ এ ধরণের তিনটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, আগামী বছর জুনে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে। এরপর কর্ণফুলী শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং বছর শেষে তরুণ প্রজন্মের ড্রিম প্রজেক্ট এমআরটি লাইন-৬ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করতে পারবেন। মেট্রোরেল এখন আর স্বপ্ন নয়। এটি এখন দৃশ্যমান-বাস্তবতা।
অন্যদিকে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, দ্রুত এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করার ছাড়া জনদুর্ভোগ কমানোর আর কোন বিকল্প এ মুহূর্তে সরকারের হাতে নেই। যদিও প্রশ্ন আছে যে প্রকল্পগুলো প্রণয়নের সময় জনদুর্ভোগ এড়াতে কোন বিকল্প চিন্তা আদৌ করা হয়েছিলো কি-না।
মেট্রোরেলের নির্মাণ শুরু হয়েছিলো ২০১৬ সালে। গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে নির্মাণ কাজের জন্য মিরপুর থেকে আগারগাঁও-ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি অর্ধেকেরও বেশি অংশ বন্ধ ছিলো, ফলে অসহনীয় ভোগান্তি দুঃসহ সময় কাটিয়েছে প্রতিদিন এসব এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ।
মিরপুর-১২ থেকে তেজগাঁওয়ে যেতে দুই আড়াই ঘণ্টা লাগতো। ভীষণ জ্যামের মধ্যে যেতে হতো। সারাক্ষণ টেনশনের মধ্যে যাওয়া। রাস্তাও ছিলো এমন যে একদিনে ভাঙ্গা চোরা আরেকদিকে অর্ধেক নাই বা একদিকে বন্ধ, আরেকদিকে খুলে দিয়েছে-এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে।
এখন আগারগাঁও পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে হওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় নির্মাণ সামগ্রী সরিয়ে সড়ক পথ চলাচলের উন্মুক্ত করা হচ্ছে কিন্তু আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের অনেক জায়গাতেই সড়ক একাংশ বন্ধ এবং সেগুলো খুলতে সেতুমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে কি-না তা এখনো নিশ্চিত হয়।
তবে মেট্রোরেলের এই রুটের কাজ শেষ হওয়ার লক্ষণ অনেকটা পরিষ্কার হলেও ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাসের আলাদা লেন তৈরির পাঁচ বছরের প্রকল্পের কাজ আট বছর পরে এসেও হয়েছে মাত্র ৪০ভাগ। এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের কারণে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত পুরো সড়ক সরু হয়ে অর্ধেকেরও কম অংশে যান চলাচল করতে পারছে।
তাও আবার বেশিরভাগ জায়গায় ভাঙ্গাচোরা, খানাখন্দে ভরা- যাকে অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন সুমনা সুলতানা। তিনি পেশাগত কাজে নিয়মিত ঢাকা থেকে গাজীপুর যাতায়াত করেন।
তিনি বলেন, প্রতিদিন যাওয়া আসা মিলিয়ে ৫-৬ ঘণ্টা লেগে যায়। এত ধুলা বালি যে শুধু গায়ের ড্রেস না, অনেক সমস্যা হয় যেমন শ্বাসকষ্ট। সামান্য বৃষ্টি হলেই মনে হয় নদী পার হচ্ছি। যানজটের যে অবস্থা হয় তা অবর্ণনীয়। অনেকেই বলা শুরু করছে যে গাজীপুর চৌরাস্তা যাওয়া মানে জাহান্নামের চৌরাস্তায় যাওয়া একই কথা।
এ প্রকল্পে জনভোগান্তি এতটাই চরমে উঠেছে যে প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশ বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি লাইন নির্মাণ প্রকল্প থেকেই সরে এসেছে সরকার। অথচ মাত্র ২০ কিলোমিটার আলাদা বাস লাইন নির্মাণ করে ২০১৬ সালে ওই সড়কে বাস নামানোর কথা ছিল। সেটি ব্যর্থ হওয়ায় নতুন করে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালে।
প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলছেন প্রকল্প নেয়ার আগে যে সমীক্ষা হয় তাতে সম্ভাব্য সব ঝুঁকির বিষয়গুলো থাকে এবং সেগুলো কিভাবে সামলানো হবে তারও উপায় দেয়া থাকে। আবার কাজ করার সময়েও কিছু সমস্যা তৈরি হয় যা ভোগান্তি বাড়ায়। তিনি বলেন এমন কিছু কারণে তারা ভোগান্তি কমাতেই প্রকল্পে কিছু পরিবর্তনও এনেছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা বলছেন প্রকল্প পরিকল্পনার সময় আর্থিক খরচের বাইরের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয় কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, সে কারণেই মানুষকে দুর্ভোগে পড়ে মূল্য দিতে হয় এবং তার কোন সমাধান পাওয়া যায় না।
মোটা দাগে একটা কষ্ট বেনিফিট এনালাইসিস সব বড় প্রকল্পে করা হয়। সে খরচের মধ্যে অনেক সময় আর্থিক খরচকে বড় করে দেখি। এর বাইরের খরচ গুলো অনেক সময় সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিন্তাও করা হয় না। উন্নত দেশে পরিবেশ, স্বাস্থ্য ঝুঁকির মতো বিষয়গুলো চুলচেরা হিসেব করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে আর্থিক ক্ষতির বাইরের ক্ষতিগুলো হিসেবে থাকেনা। অনেক সময় দেখা যায় এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও থাকে না।
তবে বড় প্রকল্পে জনভোগান্তির বিষয়কে গুরুত্ব না দেয়া কিংবা এ বিষয়ে গাফিলতির অভিযোগকে আমলে নিতে রাজী নন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলছেন যে, দুর্ভোগ হচ্ছে সেটি বাস্তব কারণেই এবং সে কারণে দ্রুততম সময়ে কাজ শেষ করা ছাড়া এ ক্ষেত্রে আর কোন বিকল্প নেই।
সড়কের নির্মাণের ক্ষেত্রে এ দুর্ভোগ বেশি হয়। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই কষ্ট বেড়ে যাবে কিন্তু এর বিকল্প তো কিছু নেই। গবেষকরা চিন্তা করে কোন পথ যদি বলে সেটি দেখবো অবশ্যই। যত কম সময়ে পারা যাবে আমাদের দায়িত্ব তত কম সময়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।


বিজ্ঞাপন