শিশুর বয়সসীমা ১৮ বছর নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশেষ প্রতিবেদক : কিশোর গ্যাং কালচার এখন সারা দেশেই পরিচিতি পেয়েছে। তবে এই পরিচিতি মোটেও ইতিবাচক নয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে ওঠা দলবদ্ধ এই অপরাধীচক্র এখন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘কিশোর গ্যাং’ এখন বড় ধরনের একটি সামাজিক সমস্যা। উদ্ভট নাম নিয়ে গড়ে ওঠা এসব দলের অনেক সদস্যই স্কুল-কলেজের গ-ি পার হয়নি। প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তা-বের শিকার হচ্ছে কেউ না কেউ।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতি, অপরাধ ও অপরাধের নানা উপাদান রয়েছে, কিশোররা তার বাইরে নয়। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ছে। এলাকায় খেলার মাঠ নেই। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তারকাখ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্বতা, অর্থলোভ। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পারিবারিক শিক্ষার অভাবও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের জন্য কিশোরদের অপরাধজগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকা-ে কিশোরদের ব্যবহার করেন। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে।
এ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মধুবাগে বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কমপ্লেক্স অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
কিশোর অপরাধ দমনে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের আওতায় ‘সবার হোক একটাই পণ, কিশোর অপরাধ করবো দমন’ শীর্ষক টিভিসির উদ্বোধন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি যখন এসএসসি পাস করেছি তখন বয়স ছিল ১৫ বছর। বর্তমানে যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে, ১৮ বছর বয়সে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আমাদের মনে হয় ১৮ বছরের এই সময়সীমা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। আন্তর্জাতিক একটি আইনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় সমন্বয় করে এটি করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে কিশোর অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেগ পেতে হচ্ছে।
কিশোররা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমাদের শঙ্কার বিষয় ছিল কোভিডকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে, সবাই বসে থাকবে। তবে এই সময়ে কিশোরদের নিয়ে যে শঙ্কাটা ছিল ততোখানি হয়নি, আমাদের দেশ অনেক দেশের তুলনায় ভালো আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, এটি ধরে রাখার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিরাপত্তা।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ-র্যাব, শিক্ষক-সমাজ তার কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারপরেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কেন? তাই বিষয়টি নিয়ে খেয়াল না করলে আমাদের সন্তানকে হারিয়ে ফেলব, দেশ-জাতির সবাই নিগৃহীত হবে। সমাজের শাসন যদি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যতোই কড়াকড়ি হোক আমরা হারিয়ে যাব।
সন্তানদের বিষয়ে পরিবারকে পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিন। তাদের সঙ্গে কথা বলুন। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে খেয়াল করুন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। তবে সন্তানদের প্রতি যদি খেয়াল না রাখেন এটি আমরা কখনই পারবো না।
একই অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, এক সময় আট বছর পর্যন্ত বয়সীদের শিশু ধরা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে কিশোর আইন হালনাগাদ করা হয়। এখন ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হয়। আইন পরিবর্তনের ফলে যখন একজন পূর্ণ যুবকের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাকেও শিশু ধরা হয়।
এর ফলে কিশোর অপরাধের বিরুদ্ধে যেভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা সেভাবে করা হচ্ছে না। তাদের ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতি, গ্রেফতার পদ্ধতি সবকিছুই আলাদা। তাদের গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে প্রফেশন অফিসারের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান আইজিপি।
তিনি বলেন, প্রফেশন অফিসাররা কাজ করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায়। আর আমরা কাজ করি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রফেশন অফিসার না থাকার বিষয়টিও রয়েছে।
কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতারের পর জেলে পাঠানো যাবে না, সংশোধনগারে পাঠাতে হয়। সেই সংশোধনাগারের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয় বলে জানান পুলিশের মহাপরিদর্শক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন প্রশ্ন রেখে বলেন, কারা কিশোরদের অপরাধী বানাচ্ছে, তাদের হাতে কারা মাদক তুলে দিচ্ছে, তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অপরাধ শুধু নিয়ন্ত্রণ না, প্রতিরোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে।
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ছোটদের সঙ্গে বড়রাও থাকে। ছোট-বড় মিলে বিরোধ হয়, পরে আলাদা গ্রুপ সৃষ্টি হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারির মতো ঘটনা ঘটে। কিশোর অপরাধ দমনে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে মানে এই নয় যে, অভিযান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। যদি কেউ সচেতনতার মাধ্যমে সুপথে না আসে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা চলমান থাকবে।