‘বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে দেশে এক কোটি তালগাছ রোপণ করা হবে। ৩৮ লাখ লাগানো হয়েছে। অনিয়মের কারণে সরকার প্রকল্প থেকে সরে এসে প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্পের উদ্যোগও নিয়েছে। বজ্রপাতের ঝুঁকি নিরসনে ৪৭৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রণয়ন হয়েছে। এর আওতায় সচেতনতা বৃদ্ধি, বজ্রপাতের আগাম সংকেত দেওয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।’
ডা. এনামুর রহমান
প্রতিমন্ত্রী
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়
নিজস্ব প্রতিবেদক : বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে তালগাছ লাগানোর একটি প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। কিন্তু ওই প্রকল্পের নামে গচ্ছা গেছে প্রায় শতকোটি টাকা। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে। অনিয়মের কারণে সরকার তালগাছ প্রকল্প থেকে সরে এসে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্প নিয়েছে বলেও জানা গেছে। পাশাপাশি তালের চারা রোপণের কর্মসূচিও চলছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ নয়, দেশব্যাপী তালের আঁটি (বীজ) লাগানোর কর্মসূচি নিয়েছিল সরকার। ইতোমধ্যেই পার্বত্য তিন জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান বাদ দিয়ে ৬১টি জেলায় তালের বীজ লাগানো হয়েছে। সরকার বলছে ইতোমধ্যেই ৩৮ লাখ তালের চারা লাগানো হয়েছে। আরও লাগানো হবে। সব মিলিয়ে এক লাখ চারা লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও এ পর্যন্ত ৩৮ লাখ তালের চারা লাগানো হয়েছে বলে বাংলা ট্রিবিউকে নিশ্চিত করেছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসীন।
মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় ২০১৮ সালে এই কর্মসূচি নিয়েছিলেন তখনকার প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও সচিব শাহ কামাল। কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান শর্তই ছিল প্রকল্পের আওতায় নির্মিত নতুন রাস্তার দুই পাশে তালের আঁটি লাগাতে হবে। বন বিভাগের পরামর্শে রাস্তার দুই পাশে লাগানো তালের আঁটি রোপণ কার্যক্রম স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ তত্ত্বাবধান করবে। নির্দেশনা ছিল প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কর্মকর্তা সরকারের এই কার্যক্রম নজরদারি করবে।
উল্লেখ্য, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালের চারা রোপণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গ্রামে প্রচুর তালগাছ ও নারিকেল গাছ থাকলে সেগুলো বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। এর ফলে বজ্রপাতে নিহত ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
লম্বা ও সরু হওয়ায় বজ্রপাত-রোধক হিসেবে তালগাছ জনপ্রিয়। অনেক দেশেই বজ্রপাতের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে এর ব্যবহার আছে।
জানা গেছে, ৩৮ লাখ তালের চারা রোপণের হিসাব খাতাকলমে থাকলেও বাস্তবে এর দেখা পাওয়া যায় না। অভিযোগ রয়েছে, এতগুলা তালের আঁটি রোপণই হয়নি। তাই বলা হচ্ছে, তালের চারা নষ্ট হয়েছে কিংবা বীজ থেকে চারা গজায়নি। যেখানে কিছু গছিয়েছে, সেখানে তদারকির অভাবে চারা নষ্ট করেছে গবাদিপশু। ফলে সরকারের এ উদ্যোগ পুরোপুরি ব্যর্থ বলা চলে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের মতে, চারাগুলো বড় হচ্ছে। কিছু নষ্ট হতে পারে। সরকারের উদ্যোগে আরও রোপণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন জানিয়েছেন, ‘কর্মসূচিটি চলছে। এ পর্যন্ত ৩৮ লাখ চারা লাগানো হয়েছে। মোট ৫০ লাখ চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছি। কাবিখা ও কাবিটা কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী রাস্তার দু’পাশে তালের বীজ লাগানো হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ দেখভাল করছে। ডিসি, ইউএনও এবং জেলার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা নজরদারি করছেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জহুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘কত চারা লাগানো হয়েছে, বা কতটি টিকেছে সেটি কাগজপত্র না দেখে বলা সম্ভব নয়। পরে সময় নিয়ে রেকর্ড দেখে বলতে পারবো।’
কতটি তালের চারা লাগানো হয়েছে তা জানাতে পারেননি খুলনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মনিরজ্জামান তালুকদারও।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ জানিয়েছেন, ‘এই উপজেলায় আগে কখনও তালের চারা লাগানো হয়েছে কিনা জানি না। তবে আমি নিজে আগামী ১৮ অক্টোবর তালের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছি।’
এ প্রসঙ্গে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, ‘বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে দেশে এক কোটি তালগাছ রোপণ করা হবে। ৩৮ লাখ লাগানো হয়েছে। অনিয়মের কারণে সরকার প্রকল্প থেকে সরে এসে প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্পের উদ্যোগও নিয়েছে। বজ্রপাতের ঝুঁকি নিরসনে ৪৭৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রণয়ন হয়েছে। এর আওতায় সচেতনতা বৃদ্ধি, বজ্রপাতের আগাম সংকেত দেওয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।’
উল্লেখ্য, গত সাড়ে ৯ বছরে বজ্রপাতে দেশে আড়াই হাজার মানুষ মারা গেছে। এ বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে মারা গেছে শতাধিক মানুষ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ২৭৬ জন। ২০১১ সালে মারা গেছে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৯৮ জন, ২০২০ সালে ২১১ জন এবং ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মারা গেছে ১০৭ জন। বজ্রপাতে প্রতিবছর গড়ে দুই শতাধিক মানুষ মারা যাচ্ছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাতও বাড়ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৪০ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসাবে বজ্রপাত বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আমাদের দেশে বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সময়কাল হচ্ছে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর।