সেই দেব শিশুর নাম শেখ রাসেল

জাতীয়

আজকের দেশ রিপোর্ট : মাত্র দেড় বছরের এক শিশু। কিন্তু তার পেছনেও গোয়েন্দা লেগেছে! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্য। বাঙালি জাতির জাগরণকালে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে জন্মেছিল যে শিশু, জান্তাদের দানবীয় ষড়যন্ত্র তাকে নিয়ে গেছে ইতিহাসের ভাগ্যহত নক্ষত্রদের কাতারে।


বিজ্ঞাপন

সেই দেবশিশুর নাম শেখ রাসেল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র।


বিজ্ঞাপন

রাসেলের বয়স তখন দেড় বছর। বাঙালির বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করেন শেখ মুজিব। এরপর, ১৯৬৬ সালের ৮ মে রাতে, তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি শোষকরা।

অবশেষে ১৯৬৯ সালে তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তি পান তিনি। হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।

বন্দি পিতার দীর্ঘ জেলজীবনের সময়টাতে, তার সঙ্গে দেখা করতে, মায়ের কোলে চড়ে নিয়মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেত ছোট্ট রাসেল।

কিন্তু গোয়েন্দারা কোলের শিশু রাসেলকে নিয়ে জেরার মুখে ফেলতেন বেগম ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিবকে।

তাই বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেচ্ছা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘বাপের পেছনে গোয়েন্দা লেগেছিল ২৮ বছর বয়সে, আর ছেলের পেছনে লাগল দেড় বছর বয়সেই।’

১৯৭১ সাল, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ রাসেলের বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। পিতা মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে, দুই ভাই কামাল ও জামাল রণাঙ্গনে।

ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটা বাসায় মা ফজিলাতুন্নেচ্ছা এবং দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে।

বড় বোন শেখ হাসিনাও তখন অন্তঃসত্ত্বা, আকাশে নিয়মিত যুদ্ধবিমানের মহড়া, পিতা ও ভাইদের দীর্ঘকাল অনুপস্থিতি।

প্রাণচঞ্চল রাসেল তখন অবসাদে ভেঙে পড়ে। প্রায়শই দুচোখ ভিজে উঠতো হৃদয়ভাঙা নোনা জলে। কিন্তু কাউকে সহজে বুঝতে দিত না সে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, প্রথমবারের মতো মুক্ত জীবনের স্বাদ পেল ছোট্ট রাসেল। ভর্তি হলো ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে।

কচিকাঁচার দলের সঙ্গে ছিল তার অবাধ মেলামেশা। বাড়ি থেকে দেওয়া টিফিন ভাগ করে খেত বন্ধুদের সঙ্গে।

সুসম্পর্ক ছিল শিক্ষক থেকে গৃহকর্মী, সবার সঙ্গে। জাতির পিতার সন্তান হিসেবে তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না।

শেখ রাসেল, এক অনন্ত বেদনার কাব্য। জেলজীবন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থেও তাকে নিয়ে লেখা আছে অনেক দুঃখগাঁথা।

১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, বড় হও, মানুষ হও, দেখতে পারবা।’

কিন্তু ছোট্ট রাসেলের আর বড় হওয়া হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট, কালরাতে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে, বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাকে। মাত্র দশ বছর দশ মাস বয়সের এক নিষ্পাপ শিশু, কী দোষ ছিল রাসেলের!

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, জন্মের পরেই চোখ মেলে দেখেছে ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি।

পাকিস্তানিদের দীর্ঘ শোষণে ক্লান্ত- সাত কোটি বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে পড়া স্বাধীনতার উত্তাপ মেখে- বড় হয়েছে যে শিশু, সে তো স্বাধীনতারই প্রতীক।

জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত মিছিল দেখে যার বেড়ে ওঠা, যার হাতে সুশোভিত উড্ডীন বাংলার জাতীয় পতাকা।

একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে, সেই ছোট্ট শিশুকেও নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট, সেই বিভিষীকাময় রাতে, ঘাতকরা যখন বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, প্রাণে বাঁচার জন্য মিনতি জানিয়েছিল ছোট্ট রাসেল।

কিন্তু ওই বুনোদল, সীমারদের মনে বিন্দুমাত্র মায়া ছিল না। শিশু রাসেলকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে এক ঘাতক সেনা।

ফোটার আগেই সুরভি ছড়াতে শুরু করেছিল যে ফুল, তার অকালে ঝরে যাওয়ার শোকে- আজও প্রতিটি ভোরে বাংলার মাঠে-ঘাটে অজস্র বকুল ঝরে।

আজও বাংলার প্রতিটি শিশুর প্রাঞ্জল হাসির শব্দে ভেসে ওঠে- রাসেলের মায়াবী মুখখানি, শিশুদের ভেজা কপোল ছুঁয়ে নামে রাসেলের চোখের পানি।