মোশতাকের নির্দেশে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে জিয়ার সেনারা

অপরাধ জাতীয়

নিজস্ব প্রতিনিধি : বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তার বিশ্বস্ত সহযোগী জাতীয় চার নেতাকে আটক করে খুনিরা।


বিজ্ঞাপন

মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের ধারণা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চার সংগঠক বাইরে থাকলে তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আবার দেশ গঠনে এগিয়ে আসতে পারে। এজন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে ছিল, ঠিক তখনই তড়িঘড়ি করে খুনিদের সহায়তায় নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেকেই স্বেচ্ছায়, আবার অনেকে বাধ্য হয়ে যোগদান করে মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। আর যারা যোগদানে রাজি হননি, তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়।


বিজ্ঞাপন

এমনকি প্রাণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততার নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএচ এম কামারুজ্জামান।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, জাতীয় ইতিহাসের আরো একটি শোকাবহ রাত। এই রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাতীয় চার নেতাকে।

খন্দকার মোশতাক ১৫ আগস্ট বিকালে নিজেকে রাষ্টপতি ঘোষণা করে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করে। ২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় সে। জিয়া ও মোশতাকের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মেজর থেকে প্রমোশন দিয়ে লে. কর্নেল করা হয়।

এরইমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যার উদ্দেশ্যে একটি ষড়যন্ত্রমূলক কালো ফরমান জারি করে মোশতাক। সেখানে বলা হয়, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা যদি প্রমাণ নাও হয় তবুও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে।

এরপর আসে ২ নভেম্বর দিবাগত রাত, তথা ৩ নভেম্বর শেষ রাতে একদল ঘাতককে জেলখানায় পাঠানো হয়।

স্বয়ক্রিয় অস্ত্র নিয়ে জেলে প্রবেশ করার চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার মোসলেহউদ্দীনসহ আরো কয়েকজন। কিন্তু জেলার তাদের নিয়মের কথা বলে আটকে দেন। এরপর তারা জেলারের অফিস থেকে ফোন করে বঙ্গভবনে।

ফোন ধরেই খন্দকার মোশতাক জেলারকে বলে, আমি খন্দকার মোশতাক বলছি। সেনাদের আমি পাঠিয়েছি। ওরা যা বলছে, আপনি তাই করুন।

রাষ্ট্রপতি মোশতাকের সরাসরি নির্দেশের পর জেলের দরজা খুলে দেন জেলার। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন জাতীয় চার নেতাকে। এরপর জেল রক্ষীদের দ্বারা তাদের শনাক্ত করার পর গুলি চালায় সেনারা।

তারপর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জ করে তাদের ওপর। কিছুক্ষণ পর, আরো একটি দল আসে। জাতীয় চার নেতার মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য মৃতদেহের ওপর নির্দয়ভাবে আবারো বেয়নেট চার্জ করে তারা।

এ ব্যাপারে ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর আইজি প্রিজন নূরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের সচিব বরাবর নিজের একটি বিবৃতি এবং জেল হত্যার ব্যাপারে তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন খন্দকার আব্দুল আওয়ালের একটি প্রতিবেদন প্রদান করেন।

সেখানে তারা জানান, মেজর রশীদ প্রথমে ফোন দিয়ে আইজি প্রিজনকে জানায় যে, জনৈক মোসলেম জেল গেটে যেতে পারে। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয়। এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএচ এম কামারুজ্জামানকে চিনিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর সরাসরি ফোনটি প্রেসিডেন্ট মোশতাকের হাতে তুলে দেয় বঙ্গবন্ধুর খুনি রশীদ। তখন মোশতাক বলে যে, রশীদ যা বলেছে তা যেন পালন করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে আরো লেখা হয়: খন্দকার মোশতাকের ফোনের কিছুক্ষণ পরেই হাজির হয় খুনিরা। তারা জানায়, জাতীয় চার নেতাকে গুলি করতে এসেছে এসেছে তারা।

একথা শুনে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান আইজি প্রিজন। তখন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আবারো ফোনে ধরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। সেসময় তিনি মোশতাক তাকে আবারো জানায় যে, তারা যা বলেছে তাই করো।

এরপর বন্দুকের মুখে ডিআইজি প্রিজন, আইজি প্রিজন, জেলার ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে বন্দি চার নেতার জেলার কাছে যায় খুনিরা। এরপর চারজনকে একটি রুমে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে আরেকটি সেনাদল এসে মৃতদেহের ওপর বেয়নেট চার্জ করে।

পরবর্তীতে ৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের আরো তিনজন বীর সেনাঅধিনায়কসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।এরপর একসময় নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে জিয়া। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের নিয়োগ দেয় বিভিন্ন দূতাবাসে।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে। এই আজিজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে গিয়েছিল।

জিয়ার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পুনর্বাসিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় খুন ও ধর্ষণে জড়িত রাজাকার সদস্যরা। দেশজুড়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা নিধন। শুরু হয় উগ্রবাদের উত্থান।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিটের কিছু কর্মকর্তা।

১৯৭১ সালে সিআইএ-এর সঙ্গে খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দীন ঠাকুর ষড়যন্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, পরবর্তীতে সেই সিন্ডিকেট সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে সাবেক আইএসআই কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের।

আর তার সঙ্গে কর্মজীবন থেকেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের। ১৫ আগস্ট কালরাতের আগে, এর আগে খুনি ফারুক ও রশীদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে।

এমনকি ১৯৭৫ এর শুরু থেকেই একাধিকবার উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও শলাপরামর্শ করে খুনি ফারুক-রশীদ, নুর ও ডালিমরা।

জিয়ার কাছ থেকে সাহস ও নিশ্চয়তা পেয়ে এই জাতির পিতাকে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করে তারা। এমনকি পরবর্তীতে একই গ্রিন সিগন্যালের মাধ্যমেই এই খুনি চক্রের হাতেই খুন হন জাতীয় চার নেতা।