ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে মামলার আবেদনের হিড়িক

অপরাধ আইন ও আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক : বেফাঁস মন্তব্য করে বেকায়দায় পড়া সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে রোববার ও সোমবার মিলে অন্তত ৬টি জেলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন জমা পড়েছে। এছাড়া একটি মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে মানহানির।
বিএনপি চেয়ারপারসন তারেক রহমানের মেয়েকে নিয়ে নারীবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী মন্তব্য করা এবং ফাঁস হওয়া একটি টেলিফোন আলাপে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহীকে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠার পর মুরাদ হাসানকে প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে। এরপর কানাডা ও দুবাই ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর নিরুপায় মুরাদ ফিরে আসেন ঢাকায়।
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলাটির আবেদন করা হয়েছে সেটি করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারুকী।
ফেসবুকে যে অনুষ্ঠানে মুরাদ হাসান কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মুহাম্মদ মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদকেও আসামি করার আবেদন করা হয়েছে।
১২ ডিসেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের সেরেস্তায় এ মামলার আবেদন করা হয়।
এই আবেদনের বিষয়ে আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার বলেন, ডা. মুরাদ হাসান ও মুহাম্মদ মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদ ব্যারিস্টার জাইমা রহমান এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ-প্রচারের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ ও মানহানিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫/২৯/৩১/৩৫ ধারার অপরাধ করেছেন। সেজন্য মামলার আবেদন করা হয়েছে।
একই ঘটনায় বগুড়া আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ দায়ের করেন। মুরাদ হাসানের সঙ্গে এখানেও আসামি করা হয়েছে নাহিদকে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, শেখ মহিউদ্দিন হেলালের ভার্চুয়াল টকশোতে অংশ নিয়ে ডা. মুরাদ হাসান ব্যরিস্টার জাইমা রহমান সম্পর্কে অশ্লীল ও শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য দিয়েছেন। এ কারণে তিনি অভিযোগটি করেছেন। আদালত অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করলেও কোনো আদেশ দেননি। পরবর্তীতে আদালত এ ব্যাপারে আদেশ দেবেন।
ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকা ও রাজশাহীর মতো এখানেও আসামি হিসেবে নাহিদের নাম রয়েছে। রোববার চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক এস কে এম তোফায়েল হাসানের আদালতে মামলার আবেদনটি করা হয়।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এস এম বদরুল আনোয়ার এ মামলার আবেদন করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘ব্যারিস্টার জাইমা রহমানকে নিয়ে ডা. মুরাদ কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকর মন্তব্য করেছেন। তিনিসহ দুই জনের বিরুদ্ধে তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৫, ২৯ ৩০ ও ৩১ ধারায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করা হয়েছে। মামলাটি আদেশের জন্য আদালত রেখেছেন।
মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা ফেসবুক লাইভে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান সম্পর্কে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ, নারীবিদ্বেষী এবং যেকোনো নারীর জন্য মর্যাদাহানিকর ভাষা’ ব্যবহার করেছেন।
রোববার দুপুরে দুপুরে সিলেটের সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেটের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট তানভীর আক্তার খান।
এ আবেদনের বিষয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যাডভোকেট আহমদ ওবায়দুর রহমান ফাহমি বলেন, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য তানভীর আক্তার খান বাদী হয়ে সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা করেছেন। আদালত ২০০ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করে আগামী ১৫ তারিখ আদেশ দেবেন মর্মে মামলা গ্রহণ করেছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন পড়েছে বরিশালের আদালতেও। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বরিশাল জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে বরিশালের সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলাটির আবেদন করেন।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুহাম্মদ মহিউদ্দিন হেলালের ভার্চুয়াল টকশোতে অংশ নিয়ে ডা. মুরাদ হাসান ব্যারিস্টার জাইমা রহমান সম্পর্কে অশ্লীল ও শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য দিয়েছেন তাই তিনি মামলাটি দায়ের করলেন। আদালত মামলাটি গ্রহণ করলেও কোনো আদেশ দেননি। পরবর্তীতে আদালত এ ব্যাপারে আদেশ দেবেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জাইমা রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে সিরাজগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সোমবার সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সদর আমলি আদালতে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
বাদিপক্ষের আইনজীবী ইন্দ্রজিৎ সাহা জানান, ডা. মুরাদ হাসান বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জাইমা রহমানকে নিয়ে কটূক্তি ও বাজে মন্তব্য করেন। এতে তাদের পরিবারে মানহানি হয়েছে।
মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন পড়েছে ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রেজাউল করিম চৌধুরী আজ এই মামলার আবেদন করেছেন।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহা. বজলুর রহমান মামলার আবেদন গ্রহণ করে আদেশের জন্য পরবর্তী তারিখ নির্ধারণে অপেক্ষায় রেখেছেন।
এ আবেদনের বিষয়ে আইনজীবী নুরুল হক বলেন, ডা. মুরাদ হাসান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানসহ বিভিন্ন নারীদের নিয়ে অশালীন ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও তিনি দেশের সব নারী জাতিকে অসম্মান করেছেন।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে শুরু থেকেই। ওই আইনে গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর চলতি বছরের শুরুর দিকে আইনটির বিরোধিতা জোরালো হয়।
বিএনপি নেতারাও বিভিন্ন সময়ে এই আইনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছেন।
চলতি বছরের অক্টোবরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল নাইনটিনের’ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, করোনাকালে গত ১৮ মাসে বাংলাদেশে জনগণের তথ্য অধিকারের ক্রমাগত লঙ্ঘন ও সংকোচন ঘটেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে দায়ের হওয়া ১৭২টি মামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে সংস্থাটি।
এই আইনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মার্চে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিএনপি নেতারা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অন্ধ বিরোধিতা করছে, আইনটির যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটছে কি না, সে বিষয়টির প্রতি সরকার কড়া নজর রাখছে। প্রযুক্তির এ যুগে জনস্বার্থেই এ আইন করা হয়েছে। আইনের অপপ্রয়োগ যাতে না হয়, সে বিষয়ে দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা। বিএনপি এখন এ আইন নিয়ে মানবাধিকারের কথা বলছে অথচ ‘৭৫-এর হত্যাকা-ের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতির পিতার খুনিদের বিচার চাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।


বিজ্ঞাপন