কম দামে জ্বালানি কিনবে বাংলাদেশ ?

Uncategorized জাতীয়

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পরছে রাশিয়ার জ্বালানি খাত। এর ফলে রাশিয়া তাদের জ্বালানি বিক্রির জন্য নতুন নতুন বাজার খোজার চেষ্টা করছে। আর ক্রেতা আকর্ষণের জন্য রাশিয়া ১৫-৩০% ডিসকাউন্টে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করছে।

তবে পশ্চিমা চাপে ছোট দেশগুলো সহসাই রাশিয়ান ক্রুড অয়েল ক্রয়ের জন্য চুক্তি করছেনা। এর ফলে রাশিয়ান তেলবাহী টেঙ্কারগুলো গন্তব্যহীন উদ্দেশ্যে রাশিয়ান বন্দর ছাড়ছে এবং গভীর সমুদ্রে আসছে। সেখান থেকে ভারত, চীনের মতো বড় দেশগুলো কম দামে তেল কিনে নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে।

রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী ভারত শুধু এক বিকেলেই ৩০মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ক্রয় করেছে। ভারত পেট্রোলিয়াম, রিলায়েন্স গ্রুপসহ অনেকেই অর্থ নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরেছে। কম দামে তেল কেনার উৎসব শুরু হয়েছে।
এদিকে চীন এতদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেও হঠাত করেই রাশিয়ান ক্রুড অয়েল ক্রয় শুরু করেছে কৌশলগত মজুদ বাড়ানোর জন্য। যদিও কত শতাংশ ছাড়ে তারা জ্বালানি ক্রয় করছে তা গোপন রয়েছে। চীন প্রতিদিন গড়ে ৮.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ক্রয় করছে যদিও চীন এর আগে প্রতিদিন 1.1 মিলিয়ন ব্যারেল তেল ক্রয় করতো।

এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কী চীন, ভারতের মতো কম দামে রাশিয়ান তেল ক্রয় করবে নাকি। বাংলাদেশ মূলত আন্তর্জাতিক বাজার থেকেই তেল ক্রয় করে থাকে। এখন বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি ব্যারেল ক্রুড অয়েলের মূল্য এখন ১৩০ ডলারের মতো। যদিও গত কয়েক বছর গড়ে ৫০-৬০ ডলারে পাওয়া যেতো। অর্থাত দ্বিগুণ দামে জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে। ৩ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে ৬ বিলিয়ন ডলারে। এখানে ডলারের উপর অতিরিক্ত চাপ পরছে। রিজার্ভে চাপ পরছে।

যাইহোক বাংলাদেশ যদি কম দামে জ্বালানি ক্রয় করতে চায় তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে মূল্য পরিশোধের জন্য বিভিন্ন নতুন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেটি হলো বাংলাদেশের সক্ষমতা। বাংলাদেশের কী জ্বালানি মজুদ করে রাখার মতো রিজার্ভার আছে? বাংলাদেশের কী ক্রুড অয়েল পরিশোধনের সক্ষমতা আছে? পরিশোধনের সক্ষমতা বলতে ক্রুড অয়েল রিফাইন করার সক্ষমতা। কারণ ক্রুড অয়েলে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই এর থেকে ডিজেল, পেট্রোল, অক্টেন, যেট ফুয়েল বিভিন্ন জ্বালানি ঘনত্ব অনুযায়ী বেড়িয়ে আসে।

এদিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বার্ষিক জ্বালানি তেলের( গ্যাস বাদে) চাহিদা ৬ মিলিয়ন টনের বেশি। কিন্ত বাংলাদেশের একমাত্র রিফাইনারি ইস্টার্ন রিফাইনারি এর তেল পরিশোধনের সক্ষমতা মাত্র ১.২ মিলিয়ন টন । এবং অনেক পুরাতন রিফাইনারি হওয়াতে এর উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। এর ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন মোট চাহিদার ৮০% পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে থাকে।

অর্থাত কম দামে ক্রুড অয়েল কিনলেও বাংলাদেশের সেটা পরিশোধনের সক্ষমতা নেই। কারণ পূর্বের অর্ডার দেওয়া তেল রিফাইন করতেই হিমশিম খাচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারি। যেহেতু কোনো জ্বালানি তেল আমদানির মোটামুটি ৩ মাস পূর্বেই এর অর্ডার দেওয়া হয় বা এলসি খোলা হয়। অর্থাত আজকে যে জ্বালানিবাহী জাহাজ বন্দরে আসছে সেটা ফেব্রুয়ারি মাসে কেনা। এবং সেটা বন্দরে আসার ১২০ ঘন্টার মধ্যে খালাস করতে হবে। নয়তো চড়া ফি দিতে হবে প্রতি অতিরিক্ত ঘন্টার জন্য। সুতরাং বাংলাদেশের সক্ষমতা নেই রিফাইন করার।

তবে কি বাংলাদেশের মজুদ করে রাখার সক্ষমতা আছে? সেটাও নেই। বাংলাদেশ এখন সর্বোচ্চ এক মাসের জ্বালানি মজুদের সক্ষমতা রয়েছে।
যা ১ মিলিয়ন টনের আশেপাশে। যদিও অনেক দেশের মজুদ করার ক্ষমতা ৩-৯ মাস পর্যন্ত।
যাইহোক আশার বাণী হচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারি এর সক্ষমতা ৩ মিলিয়ন টন বৃদ্ধি করার জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। যদিও এটা ২০১০ সালের পদক্ষেপ ছিল। কিন্ত ফ্রান্স অত্যধিক বেশি দাম চাওয়ায় সরকার এতদিন গ্রীন সিগন্যাল দেয়নি। সম্প্রতি ভারতীয় একটি পরামর্শক দল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে পরামর্শ দিয়েছে টেন্ডারের মাধ্যমে ভেঙে ভেঙে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ অর্ধেক খরচে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। সরকার সেই দিকেই যাচ্ছে।

তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে অনেক দেরি। বাস্তবায়ন হলে এর মোট সক্ষমতা হবে ৪.৫ মিলিয়ন টন বার্ষিক। তবে আসল সুসংবাদ হচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ কিন্ত ১০,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি রিফাইনারি তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। এই বছর নয়তো আগামী বছর উৎপাদনে যাবে এটি। এর সক্ষমতা প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ব্যারেল বা ৪.৭ মিলিয়ন টন বার্ষিক। অর্থাত দেশের মোট চাহিদার ৮০% মেটানোর সক্ষমতা থাকবে এটির। আশা করা যায় বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে উৎসাহিত হয়ে আরো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় সেটি হলো আমাদের মজুদ সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরী। সক্ষমতা থাকলে আজকে করোনাকালীন সময়ে ফুলে উঠা রিজার্ভের টাকা দিয়ে একদম কম দামে জ্বালানি মজুদ করতে পারলে এখন এত হাহাকার দেখা দিতোনা।


বিজ্ঞাপন