অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ ভাল স্বপ্ন সত্যি করতে আমরা কত প্রচেষ্টাই করি। কিন্তু যখন সেটার প্রেক্ষিত ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র হয় তখন চাইলেই সব কিছু করা উচিত নয়। দরকার সার্বিক সামর্থ্য, অর্থনৈতিক লাভ সহ অনেক বিষয় নিয়েই ভাবতে হয়। পরিকল্পনা করতে হয়।
বাংলাদেশের ঢাকা চট্টগ্রাম বুলেট ট্রেন প্রকল্প নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এ রেলপথটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে খরচ হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। সমীক্ষায় হাইস্পিড রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৪০ কোটি ($১১.৪০ বিলিয়ন) ডলার (শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম অংশ)। বর্তমান বিনিময় হারে (প্রতি ডলারে ৮৬ টাকা ০৫ পয়সা) এর পরিমাণ ৯৮ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। সমীক্ষা অনুযায়ী, হাইস্পিড রেলপথটি নির্মাণ করা হবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম রুটে। রুটটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২২৭ কিলোমিটার। এর ৯৬ শতাংশ হবে এলিভেটেড। রেলপথটি হবে শুধু যাত্রী পরিবহনের জন্য। ডিজাইন স্পিড ধরা হয়েছে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। স্ট্যান্ডার্ড গেজের দুটি লাইন নির্মাণ করা হবে, যেগুলোর এক্সেল লোড হবে ১৭ টন ধারণক্ষমতার। বিদ্যুৎচালিত রেলপথটি হবে পাথরবিহীন। ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক ‘অটোমেটিক ব্লক’ সিগন্যাল ব্যবস্থা। রেলপথটিতে একটি ট্রেন বিরতিহীনভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে সময় নেবে ৫৫ মিনিট। আর বিরতি দিয়ে চললে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগবে ৭৩ মিনিট।এখন প্রেক্ষিত পরিবর্তন করে একটু চিনের দিকে যাওয়া যাক। বিশ্বের মোট হাই স্পিড রেল নেটওয়ার্ক এর দুই তৃতীয়াংশ চীনের। প্রায় ৪০,০০০ কিলোমিটারের বিশাল হাই স্পিড রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে দেশটির। কিভাবে চিন এটা সম্ভব করল? আর এর পরিনতিই বা কি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্বে যখন রেসিশন তখন এর থেকে উত্তরনের জন্য চিন একটু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। তারা সারাদেশে হাই স্পিড রেলের মহা কর্মযজ্ঞ শুরু করে। এতে লাভ কি? সিমেন্ট, স্টিল খাত সহ নির্মানজজ্ঞের সাথে যুক্ত কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এতে মন্দা দ্রুত কেটে যায়। স্টিমুলাস হিসাবে অবকাঠামোয় এই বিশাল কর্মজজ্ঞে রেসিশন থেকে যেমন মুক্তি মিলেছে তেমনি চিনে গড়ে উঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ হাই স্পিড রেল অবকাঠামো। সমস্যা এখানেই শুরু। ইকোনমিক রিটার্ন বিবেচনা না করে এত বেশি অর্থ চিন এই প্রকল্পে ব্যয় করে যে, এই প্রকল্পের সংরক্ষন ও চালু রাখতে প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় হতে থাকে। কিন্তু কয়েকটি রুট বাদে দেশের অধিকাংশ রুটেই পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যায়নি। ফলে এই প্রকল্প থেকে আয়, প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট ছিলনা। আর শুধুমাত্র এই কারনে চাইনিজ রেলের মোট ঋন অবিশ্বাস্যরকম বৃদ্ধি পেতে থাকে। ডলারের হিসাবে চিনা রেলের দেনা এখন $২ ট্রিলিয়ন ডলার ($২০০০ বিলিয়ন) ছাড়িয়েছে যা কিনা প্রায় ভারতের মোট জিডিপির কাছাকাছি!
আসুন এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুলেট ট্রেনকে বিবেচনায় আনি। প্রায় ৳১ ট্রিলিয়ন টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মাত্র ৭৩ মিনিটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। কিন্তু প্রকল্পের খরচ এতটায় বেশি যে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, আমাদের দেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প আগে বাস্তবায়ন না করে বুলেট ট্রেন কতটা ফলপ্রসু হবে। বাংলাদেশ কিন্তু চিন বা ভারতের মত এত বড় দেশ নয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের সল্প দুরত্বে প্রচলিত দ্রুত গতির ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ করলে যদি ট্রেন ১৩০ কিমি/প্রতি ঘন্টা বেগে চালানো সম্ভব হয় তবে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগবে ২ ঘন্টা বা আড়াই ঘন্টা। প্রচলিত রেলে শুধু যাত্রী পরিবহন নয়, বরং পণ্য পরিবহন করা যাবে যেটা এই রুটের সব থেকে গুরুত্ববহ ইস্যু।
যেহেতু বুলেট ট্রেনের উদ্দেশ্য যাত্রী পরিবহন তাই এক লক্ষ কোটি টাকার এই প্রকল্পে পণ্য পরিবহনের সুযোগ থাকছে না। এত অর্থের বিনিময়ে নির্মিত প্রকল্পে প্রচলিত রেলের ২.৫ ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ কম সময় লাগবে ৪৫-৪৭ মিনিট মাত্র। কিন্তু বুলেট ট্রেনের ভাড়া অবশ্যই অনেক বেশি হবে যেটা এদেশের অধিকাংশ যাত্রী মাত্র ৪৫ মিনিট বাচাতে যেয়ে ব্যয় করবে না। সেই সাথে বুলেট ট্রেনকে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ পুষিয়ে লাভে আনতেও প্রতিদিন ২০ টার বেশি আপ ও ডাউন ট্রিপ লাগবে। এত বেশি যাত্রী বেশি ভাড়ায় এই রেলের গ্রাহক হবেন বলে মনে করিনা যেখানে প্রচলিত এবং বাস্তবায়নাধীন ডাবল লাইন প্রকল্পেই মাত্র ২.৫ ঘন্টায় তারা যেতে পারবে। বাংলাদেশ যদি আকারে অনেক বড় হত তবে হয়ত এর উপযোগীতা থাকত। কিন্তু সল্প দুরত্বে ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋনের বোঝা নিয়ে যাত্রার সময় মাত্র ৪৫ বা ৫০ মিনিট কমানো সাভাবিক ভাবেই লাভজনক হবে না বোঝায় যায়।১ লক্ষ কোটি টাকার সুদ যদি ৩% ও হয় তবে সেটি প্রতি বছরে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা। এত টাকা উঠে আসবে কিভাবে সেটা কিভাববার বিষয় না? লাওস খুব বেশি ধনী দেশ নয়। তবে চীনের সাথে বুলেট ট্রেনের প্রকল্পে লাওসের ঘাড়ে $৭ বিলিয়ন ডলারের ঋনের বোঝা যুক্ত হয়েছে। ১১০ কোটি টাকার বিস্তারিত নকশা ও সমীক্ষায় ব্যয় হওয়া তথ্যে আমরা বুলেট ট্রেনের যে খরচ $১১.৪০ বিলিয়ন হবে এটা জানতে পেরেছি। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা এই প্রকল্পে যাব নাকি যাব না? এটা আবেগের বিষয় নয়। বরং ১ লক্ষ কোটি টাকা এখানে ব্যয় না করে অন্যান্য প্রেসিং প্রকল্পে ব্যয় বেশি যুক্তিযুক্ত। যদি যুক্তির খাতিরে কেউ প্রশ্ন করে যে, বুলেট ট্রেনে ফ্রেইট ট্রান্সপোর্ট ও থাকবে। তাহলে কি এটা লাভজনক হবেনা? এর উত্তরেও একি প্রশ্নই করতে চাই। পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ১ ঘন্টা সময় বাচানোর জন্য আপনি নিজে ব্যাবসায়ী হিসাবে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করতে কি রাজি হবেন? যাহোক, ঋনের সুযোগ থাকলেই ঋন নেয়া উচিত নয়। বরং যেই প্রকল্পে ঋন নেয়া হচ্ছে সেটার ROI বিবেচনা করা উচিত সেই সাথে পাবলিক বেনিফিটস। আমরা ঋন নিব কিন্তু ঋন আর ঋনের ফাঁদ দুটির মধ্যে আমাদের বিবেচনা করা উচিত। এমন খাতে নেয়া উচিত হবেনা যেটা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে যায়।