অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ ডলারের স্ট্রং পয়েন্ট হল এর উপর আস্থা। এই আস্থার জোরে বিশ্বের প্রায় সব দেশে ডলার গ্রহণযোগ্যতাতা রাখে যেটা অন্য কোন মুদ্রার ক্ষেত্রে এত ব্যাপকভাবে হয়নি। যদি ডলারে বিকল্প হিসাবে কোন মুদ্রা সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা রাখে তবে সেটি ইউরো।আইএমএফ এর কারেন্সি বাস্কেটে ইউয়ান স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৬ তে। বাংলাদেশে সেই স্বীকৃতি ২০১৮ তে যদি ভুল না করে থাকি। কিন্তু ইউয়ানে নস্ট্রো একাউন্ট খোলার নির্দেশনা এতকাল পরে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই টপিকে লিখতাম না। কিন্তু বিরক্ত হয়ে লিখছি। এর কারন হল, ভারতের স্টেটস ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (যার শাখা বাংলদেশে রয়েছে) ভারতের সাথে ডলারে বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে বলে বিজনেস স্টান্ডার্ড এর একটি খবর সামনে এলো। এই ব্যাংকের মাধ্যমে ভারতের সাথে ট্রেড করতে গেলে রুপিতে করতে হবে। এর আগে ব্যাংকটি ভারতের রপ্তানিকারকদের বাংলাদেশের সাথে রুপি ও টাকাতে লেনদের করতে বলেছিল। এরুপ পরিস্থিতির একটা ছোট্ট ব্যাখা মাথায় আসে। রুপিকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া রুপির মান ধরে রাখতে বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। এর ফলে রুপির মান ধরে রাখতে গিয়ে ভারতের ডলার $৬৪৭ বিলিয়ন থেকে কমে $৫৫০ বিলিয়নে নেমে এসেছে বলে টিওয়াই এর রিপোর্টে দেখলাম। অর্থাৎ রুপির দাম না কমানোর জন্য তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় $১০০ বিলিয়ন রিজার্ভ কমতে পারে জেনেও রুপির অবমূল্যায়ন করছে না। ভারত এটা পেরেছে কারন ওদের পর্যাপ্ত ডলার মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর বিপরীতে টাকার বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দিয়েছে এবং টাকাকে অবমূল্যায়ন হতে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে রিজার্ভের স্থিতি এখন স্টাবল। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ইউয়ানের দর ও পড়েছে। এমন কোন মূদ্রা নেই যে দেশের মুদ্রা বিগ ব্লো ফেস করে নাই। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে খুব কম। এর থেকে যেটা স্পষ্ট ভারত রুপিকে গ্লোবাল কারেন্সি করবার প্রচেষ্টায় রয়েছে। এতদিন নেপাল, ভুটানে রুপি চালালেও গ্লোবাল কারেন্সিতে রুপ্তান্তরের সাহস ভারত করেনি। কিন্তু রাশিয়ার সাথে রুপি রুবল ট্রেডের সুযোগ ভারতকে রুপি নিয়ে উচ্চাশা পোষনের ইঙ্গিত দেয়। রাশিয়া যুদ্ধের কারনে নিরুপায় হওয়া রুপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। কিন্তু সেটি কি কতটুকু বেড়েছে বা বৃদ্ধির যৌক্তিকতা কতটুকু? প্রথমত রুপি আইএমএফ এর কারেন্সি বাস্কেটের মুদ্রা নয়। এখনো রিজার্ভ কারেন্সি নয় যেটা ইউয়ানের ক্ষেত্রে আংশিক সম্ভব।অথচ এরকম বাস্তবতায় যখন কোন ব্যাংক ডলারে ট্রেড করাকে সাসপেন্ড করে তবে সেটাকে সহজ ভাবে ব্যাখা করলে দাঁড়ায় রুপিকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হিসাবে। এটা রুপির প্রতি আস্থ বৃদ্ধি করবে না। বরং অনাস্থা বৃদ্ধি করবে। কারন এটা ম্যাচিউর সিদ্ধান্ত হতে পারেনা।
এরুপ ক্ষেত্রে রুপিতে বা ইউয়ানে ট্রেডে আমরা কি আসলেই উপকৃত হব?
আমাদের আপাতত উপকৃত হবার সুযোগ নেই। এর প্রধান কারন হল আমরা চীন এবং ভারত উভয় দেশের সাথেই বাণিজ্য ঘাটতিতে আছি। যেহেতু আমাদের আমদানি কম তাই তাদের সাথে ট্রেড করতে গেলে আমাদেরকে রুপি বা ইউয়ান কিনতে হবে। সাথে ভারত বা চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে আমাদের তেমন কোন লাভ হবেনা।
আরেকটু ব্যাখা করি। ধরুন রুপি বা ইউয়ান আমাদের রিজার্ভ কারেন্সির ৩০% দখল করে আছে। এর প্রভাব খুব বাজে ভাবেও পড়তে পারে। কিভাবে? সহজ ভাবে বলতে গেলে এতে আমাদের সামর্থ্য কমবে। কারন ভারতে রুপি গ্রহণযোগ্য হলেও রুপি গ্লোবাল কারেন্সি নয়। ধরুন আমাদের রিজার্ভ ১০০ টাকা যার ৩০ টাকা আছে রুপিতে। যেহেতু রুপি এখনো বিশ্বে গ্রহণযোগ্য কারেন্সি নয় তাই এই ৩০ টাকা সমপরিমান রুপি আমাদেরকে ভারতের বাইরে অন্য দেশের সাথে ট্রেডে আমাদের কোন সুবিধস দিতে পারবে না। শুধুমাত্র ভারত ব্যাতিত অন্য দেশে আমাদের রিজার্ভের ৩০ টাকা কাজে আসবে না। বিষয়টা জটিল। কিন্তু সহজ করে বললে এভাবেই দাঁড়ায়। আর এই একি কারনে বাংলাদেশকে রিজার্ভের এই ৩০ টাকা সমপরিমান রুপি শুধু ভারতের সাথে বাণিজ্যে ব্যবহার করতে হবে যা ভারতের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াবে।
যদি চীনের ইউয়ানের ক্ষেত্রে এমনটা হয় তাহলে কি হবে? সেক্ষেত্রেও আমাদেরকে একি সমস্যায় পড়তে হবে। তবে আইএমএফ এর স্বীকৃত কারেন্সি হিসাবে বিশ্বের অনেক দেশ ইউয়ানে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দেশ রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবেও স্বীকৃতি দিচ্ছে যেটা রুপির ক্ষেত্রে হয়নি। তথাপি বড় অংকের ইউয়ান এক্সপোজার আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি একি রকমের দুর্বল করে তুলবে কারন এখনো ইউয়ানের থেকেও বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতায় ব্রিটিশ পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার এগিয়ে।
ইউয়ান যতদেশে পেমেন্ট গ্রহন করে তার থেকেও বেশি দেশ পাউন্ড পেমেন্ট গ্রহন করে। এই অবস্থা কাটা এক বা দুই দিনের বিষয় না। এটা ইম্যাচিউর সিদ্ধান্ত নিয়ে ডলার লেনদেন বন্ধ করে দিয়ে হয়না। এই পরিবর্তনের জন্য বহু বছর প্রয়োজন। হয়ত কোন এক সময় গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে রুপির। তবে বর্তমান বাস্তবতায় ইউয়ানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি। আইএমএফ এর কারেন্সি বাস্কেটের স্বীকৃত মুদ্রা হতেও রুপির অনেক দূর যেতে হবে। এই মুহুর্তে রুপিতে ট্রেড করতেই হবে এমন শর্তে যাওয়া ঠিক হবেনা। যদিও আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ সেটা করবেও না। কারেন্সি সোয়াপ হলে এবং সীমিত পরিসরে হয়ত হতে পারে। ডলারের বিকল্পের জন্য কি করা যেতে পারে? গ্রহণযোগ্যতার বিচারে ডলারের পর ইউরোকে ধরা যায়। এর কারন ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্নত অর্থনীতি গুলির জোটের অভীন্ন মুদ্রা। যেহেতু এখানে এক দেশের প্রভাব নেই তাই এর রাজনৈতিক ব্যাবহারের ঝুকিও কম। ডলারের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে রাজিনৈতিক ভাবে ডলারকে ব্যাবহার না করা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু রুশ ইউক্রেন যুদ্ধে ডলারের রাজনৈতিক ব্যাবহার ডলারের আস্থায় ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। ইউয়ান, রুপি, রুবল এই ধরনের দুর্বক কারেন্সিতে এক্সপোজার বৃদ্ধির থেকে যদি এমন করা যায় যে RCEP জোটের দেশগুলি প্রচলিত মুদ্রার পাশাপাশি অভীন্ন মুদ্রার প্রচলন করে তবে সেটির একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’র ইতিবাচক দিক আছে বলে ধারণা করা হয়।
