যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ওয়াশিংটন পোস্টে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার

Uncategorized আন্তর্জাতিক



কুটনৈতিক প্রতিবেদক ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে দেশটির প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট পেটুলা ডিভোরাককে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারের আলোকে ‘ডিসপাইট বিয়িং আ উইমেন’ হ্যাশট্যাগে তাঁর লেখা ‘দিস প্রাইম মিনিস্টার লাফড অ্যাট দ্য মিম সি ইনসপাইয়ার্ড’ শিরোনামে গত সোমবার প্রকাশিত হয়। যার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো তিনি তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়েকে উঁচু করে তুলে ধরেছেন।রিৎজ-কার্লটন হোটেলের বলরুমে কালো স্যুট পরা মানুষের ভিড়ে শিশুটির গোলাপি পোশাক উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছিল।তার বাবা আবদুল্লাহ নিয়ামি বলছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে দেখানোর জন্য আমি তাকে নিয়ে এসেছি।’নিয়ামির মেয়ের নাম জয়া।সে যুক্তরাষ্ট্রে নর্দার্ন ভার্জিনিয়ার একটি স্কুলে ফার্স্ট-গ্রেডে পড়ে। নিয়ামি গত সপ্তাহে এমন একজন নারী সরকারপ্রধানকে দেখাতে তাঁর মেয়েকে নিয়ে আসেন, যা যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা দেখা যাবে না।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নর্দার্ন ভার্জিনিয়ার রিজ কার্লটন হোটেলে অবস্থান করছিলেন। এই সফরে লন্ডনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান শেষে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার মতো ব্যস্ত সূচির মধ্যে তাঁর এই হোটেলে অবস্থানের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো নয়।জাতিসংঘে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বসম্প্রদায়ের বিবেক জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।‘আমি তাদের জন্য রান্না করি’ শেখ হাসিনা বিশ্বের দীর্ঘতম সময়ের নারী সরকারপ্রধান। তিনি রাশিয়ার চেয়ে বেশি জনবহুল একটি দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গ্রেনেড হামলাসহ অন্তত ২০ বার হত্যাচেষ্টা থেকে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন।পাশাপাশি তিনি একজন মাতামহী। নিজের ৭৬তম জন্মদিনটি তিনি তাঁর ছেলে ও ১৬ বছর বয়সী নাতনির সঙ্গে উদ্‌যাপন করেছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর বাইরের একটি শহরতলিতে বসবাস করেন।
আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করি, প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি কীভাবে সাধারণ একজন দাদির মতো ভূমিকা পালনের সময় পান, তখন তিনি বলেন, ‘আমি তাদের জন্য রান্না করি। চিকেন বিরিয়ানি…আমার ছেলের বাসায়,শুধু আমার জন্যই একটা রান্নাঘর আছে।’ আমরা এসব জানতে পেরেছি, কারণ এই সফরসূচিতে শেখ হাসিনার একটি একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।
সাক্ষাৎকার নিতে আমরা একটি সুদৃশ্য কক্ষে বসেছিলাম। সঙ্গে ছিলেন তাঁর অনুবাদক ও সচিব। কক্ষে তাঁর বাবা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বড় ছবি ছিল। বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পরিবারের ১৭ সদস্যসহ ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হয়। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বাবার পরম্পরা বহন করে চলছেন।
শেখ হাসিনা একটি জটিল, গতিশীল জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি নিজে একজন কঠিন নেতা। জাতিসংঘে ভাষণে শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য সহায়তা চেয়েছেন। তিনি বলেন, শরণার্থীশিবিরের জীবন ভালো নয়। তারা তাদের দেশে ফিরতে চায়।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশের এই সংকটকে আমেরিকার অভিবাসী–সংকটের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। উত্তর থেকে দক্ষিণে হাত প্রসারিত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকা…একটি বিশাল দেশ। এখানে অনেক জমি, অনেক জায়গা, কাজের অনেক সুযোগ। প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে কেন এই অভিবাসীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে? ১৭ কোটির বেশি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে দেশটির অবস্থান অষ্টম। তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু আমরা ছোট দেশ।’পাশে থাকা শেখ হাসিনার সচিব যোগ করেন, ‘আমাদের দেশের আয়তন উইসকনসিনের (যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য) সমান।’রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আছে। তার সঙ্গে চলমান সেন্সরশিপের অভিযোগ ও আক্রমণাত্মক পুলিশ বাহিনীর বিষয়টিও আছে। এই বাহিনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার অভ্যন্তরীণ জঙ্গিবাদ দমন করেছে।এই জঙ্গি দমন অভিযানের জন্য তাৎক্ষণিক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার কঠোর, শূন্য সহনশীল মনোভাবের জন্য ২০১৫ সালে তাঁকে অভিনন্দন জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও…’।মোদির এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যা শেখ হাসিনার জন্য গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।আমি যখন শেখ হাসিনাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করি, তিনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলেন, ‘পুরুষের চেয়ে নারীরা ভালো।’ তিনি হাসলেন।এরপরই তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, তিনি একজন নারী। আর সে কারণেই তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও শিক্ষার সংগ্রাম এবং বেশির ভাগ নারী যেসব বাধার মুখোমুখি হন, সেসব গভীরভাবে বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন, কীভাবে নারীদের স্থবিরতা একটি জাতির অগ্রগতিকে শ্লথ করে দেয়।গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী দেশের দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছেন। শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়েছেন। আবাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করেছেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা যেগুলোকে কুঁড়েঘর বলেন, তা আর নেই।’ সেগুলো সাধারণ কাঠামো হতে পারে, ইটের দেয়াল ও টিনের ছাদ হতে পারে। তবে বাংলাদেশ আবাসনকে একটি মানবাধিকারে পরিণত করেছে।শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেন, এর মালিকানা নারী ও পুরুষ উভয়ের নামে হবে। তারপর তিনি আবার ফিসফিস করে বলেন, যদি তাঁদের বিচ্ছেদ হয়, বাড়িটি নারীর থাকবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির উচ্চমূল্যায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। ১৯৭১ সালে জন্মের সময় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশটি ২০১৫ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। শেখ হাসিনা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসনের মাধ্যমে নারীদের জন্য বিনিয়োগ দেশকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। এসব কথা তিনি গত সপ্তাহে জাতিসংঘে বলেছেন। শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, তাঁর সফরের শেষ ভাগ কিছুটা নিরিবিলিভাবে পার করবেন। কিন্তু এই এলাকার বাংলাদেশিদের কাছে তাঁর হোটেলে অবস্থানের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তিনি যখন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষ করেন, তখন হোটেলের লবি তাঁর সমর্থকে পরিপূর্ণ।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *