আজকের দেশ ডেস্ক ঃ অবিভক্ত বঙ্গে বিশেষ করে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন, মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাতে গড়া ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে যে কজন মনীষীর অক্লান্ত শ্রম সমকালীন মুসলিম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে তাঁদের মধ্যে যাঁর নাম অগ্রগণ্য তিনি হলেন শেফাউল মুলক হাকীম হাবিবুর রহমান খান আখুনজাদা। মহান এই মানুষটিই এই বঙ্গে তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবাসীর জন্য ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন।
সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি এই বঙ্গদেশের ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক। ১৮৮১ সালের ২৩ শে মার্চ এ মহাপুরুষ এ অঞ্চলের মুসলিম সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র মসজিদ নগরী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা মোহাম্মদ খান আখুনজাদা উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক সম্ভ্রান্ত ধর্মীয় শিক্ষক পরিবারের লোক ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বংশধর ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা ইরানের হেরাতে বসতি স্থাপন করেন। অবশেষে মাওলানা মোহাম্মদ খান আখুনজাদা ঢাকায় আগমন করে এখানেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। পারিবারিক ভাবে তাঁরা শিক্ষা আদান-প্রদানের মত মহৎ কর্মের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। ফলে তাঁরা আখুনজাই পরিবার (যার অর্থ শিক্ষক পরিবার) নামে পরিচিতি লাভ করেন। শেফাউল মূলক হাকিম হাবিবুর রহমান বাল্যকালে পারিবারিক পরিবেশে ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ঢাকার হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মাত্র ১৩ বছর বয়সে ধর্মশাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভারতের উত্তরপ্রদেশের কানপুরে গমন করেন। সেখানে তিনি ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে হাদীস শাস্ত্র, মানতেক (যুক্তিবিদ্যা), তাফসির প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করেন।কানপুরের তৎকালীন হাকীম সাহেবদের জনসেবামূলক কাজকর্ম দেখে তিনি ইউনানী চিকিৎসা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাই দ্বীনি শিক্ষা সমাপনের পর ইলমে তিব্ব তথা ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যে লাখনৌ গমন করেন।
অতঃপর তিনি ১৮৯৯ সালে আগ্রায় গমন করে তথাকার প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী হাকীম আগা হাসানের তত্ত্বাবধানে থেকে ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্রে অগাধ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
হাকীম সাহেব ১৯০১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে একজন ইউনানী চিকিৎসক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের পাশাপাশি দর্শনতত্ত্ব, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ও পান্ডিত্যের বিষয় অল্প দিনের মধ্যেই স্থানীয় সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।তাঁর পাণ্ডিত্যের সংবাদ লোক-মুখ হতে নবাব পারিবারের কর্ণগোচর হতে খুব বিলম্ব হলো না। অল্পদিনের মধ্যে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ হাকীম সাহেবের মেধার পরিচয় পেয়ে তাঁকে নবাব পারিবারের চিকিৎসকরূপে নিয়োগ প্রদান করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯২১ সালে তদানীন্তন বাংলা সরকার ইউনানী চিকিৎসা সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটি কলিকাতা ও ঢাকায় সরকারি পর্যায়ে দুটি ইউনানী কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিল। সরকার কমিটির সুপারিশ নীতিগতভাবে মেনে নিলেও অর্থাভাবের অজুহাতে ইউনানী কলেজ প্রতিষ্ঠায় অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি এতে হতোদ্যম না হয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ নামে বাংলাদেশে প্রথম “চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান” গড়ে তুলেন, যা আজও বকশীবাজারের ২৫ উমেশ দত্ত রোডে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলেজটি অল্পদিনের মধ্যেই তদানীন্তন বাংলা, আসাম ও বিহার সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠানটির সুখ্যাতির কারণে শুধু পূর্ব বঙ্গের শিক্ষার্থীবৃন্দই নয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষার্থীরাও এখানে শিক্ষা অর্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতো। এক্ষেত্রে পশ্চিম বঙ্গের বিখ্যাত ইউনানী চিকিৎসক হাকীম ইউনূস হাবিবীর (হাবিবী উপাধিটি তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের ইঙ্গিতবহ) নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “কারাবাদীনে বাঙ্গালা” এর ভূমিকায় বেশ কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে হাকীম হাবিবুর রহমানের প্রশংসাগাঁথা লিপিবদ্ধ করেছেন।অবিভক্ত বাংলার তদানীন্তন গভর্নর লর্ড ফ্রেডারিক বোর্ন ১৯৪৪ সালে তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্রদের সনদ বিতরণ করেন। হাকীম সাহেব বাংলা ও আসামের ইউনানী চিকিৎসকগণকে সংগঠিত করার জন্য ১৯৪০ সালে “আঞ্জুমানে আতিব্বায়ে বাঙ্গাল ও আসাম” (বর্তমানে এটি বাংলাদেশ ইউনানী মেডিকেল এসোসিয়েশন নামে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলা সরকার ইউনানী চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন এর জন্য প্রাদেশিক পরিষদে আইন পাস করেন এবং জেনারেল কাউন্সিল ফর স্টেট ফ্যাকাল্টি অব ইউনানী মেডিসিন বেঙ্গল গঠন করেন। ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারে হাকীম সাহেবের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তদানীন্তন ভারত সরকার তাঁকে “শেফা-উল- মুলক” উপাধি প্রদান করে সম্মানিত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্বাধীনচেতা এই মানুষটি ইংরেজদের কূটকৌশলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯৪৪ সালে এই উপাধি বর্জন করেন। এই বঙ্গের মানুষের মায়ের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা বাংলা, যা হাকীম সাহেবের অজানা নয়। তাই চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে তিনি বাংলা ভাষায় ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম মাসিক পত্রিকা “শেফা” প্রকাশ করেন। এর বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর রচনা সমূহের মধ্যে আসূদগানে ঢাকা, শুয়ারায়ে ঢাকা, মসজিদে ঢাকা, ছালাছায়ে গাসসালা, ঢাকা কী তারীখী ইমারত, ঢাকা পাচাস বরস্ পাহলে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য সংকলন ও মুদ্রিত পুস্তক। উল্লেখ্য যে, হাকীম সাহেব ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন।
