নিজস্ব প্রতিবেদক ; রাজধানী সহ দেশের গুপ্ত হত্যা মামলাসহ ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন পিবিআই এর সাফল্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে। চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি গ্রেফতার ও রহস্য উদঘাটনে পিবিআই যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে পিবিআই এর তদন্তধীন কিছু মামলার বিষয় নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন।
রংপুরের বোনারপাড়ায় আল আমীন ওরফে নয়ন এবং ময়মনসিংহের নান্দাইলে খাইরুল ইসলামের মরদেহ উদ্ধার হয় রেললাইন থেকে। রাজধানীর চকবাজারে বাসা থেকে আনিসুর ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাড়ির পাশের একটি গাছ থেকে মোনায়েম খাঁর গলায় ফাঁস দেওয়া ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম দুজনের মৃত্যু রেল দুর্ঘটনাজনিত এবং পরের দুজন আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) তদন্তে উঠে আসে চারটি ঘটনাই ছিল হত্যাকা-। পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করে রেল দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইয়ের কাছে আসা এ ধরনের ২২টি মামলার রহস্য ভেদ করেছে সংস্থাটি। প্রতিটি ঘটনাই ছিল হত্যাকা-। আসামিরা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে।
পিবিআই সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণত অপমৃত্যুর মামলা হয়। কিন্তু অন্য সংস্থার তদন্তের পর আদালতে বাদীর নারাজির পরিপ্রক্ষিতে পিবিআইতে আসে অধিকতর তদন্তের জন্য। এমন অসংখ্য মামলা এখনো পিবিআইয়ের তদন্তাধীন।
আইনজ্ঞরা বলছেন, ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশের তদন্তে ভুল হলে আসামিপক্ষ সুবিধা পায়, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ময়নাতদন্তের ভুল প্রতিবেদন ও পুলিশের তদন্তকারীদের উদাসীনতায় এমন অনেক মামলার বিচার হচ্ছে না।
ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালতে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্ট ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে।
মামলা হওয়ার পর সুষ্ঠু তদন্ত করে নির্ভুল প্রতিবেদন আদালতে পেশ করতে হবে। হত্যাকা-কে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিলে হবে না। এত বড় ভুল হওয়ার কথা নয়, এমন ভুল করা যাবে না। তদন্তে ভুল হলে আসামিপক্ষ বেনিফিট পায়।’ তিনি বলেন, ‘তবে তদন্ত রিপোর্টই চূড়ান্ত না। আদালতেরও বিষয় আছে। ভুল প্রতিবেদন দিলে তো আদালত ভুল করবে না।’
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যু অথবা মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে অথবা অন্য কোনো কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন ময়নাতদন্ত করা জরুরি তখন কাছের সিভিল সার্জনের কাছে ময়নাতদন্ত করার জন্য লাশ পাঠিয়ে থাকেন।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছতে প্রভাবিত করতে পারে। ভুল প্রতিবেদনের মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তি হলে প্রকৃত ঘটনা আড়ালেই রয়ে যায়।
পিবিআই উদঘাটিত ঘটনার মামলাগুলো হয়েছিল রংপুরের বোনারপাড়া রেলওয়ে ও মিঠাপুকুর থানায় দুটি, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় দুটি, ডিএমপির ওয়ারী ও চকবাজার থানায় দুটি, ময়মনসিংহের নান্দাইল ও ত্রিশাল থানায় চারটি, গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর থানায় দুটি, গোপালগঞ্জ সদর ও কোটালীপাড়া থানায় দুটি। এ ছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানা, রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানা, রাজবাড়ীর পাংশা থানা, নেত্রকোনা মডেল থানা, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানা, বগুড়ার শেরপুর থানা ও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানায় একটি করে মামলা হয়েছিল।
পিবিআইপ্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) বনজ কুমার মজুমদার গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হত্যা বা অপমৃত্যুর মামলা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদেনের ওপর ভিত্তি করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এতে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, পিবিআইতে আসা যেসব মামলায় এখন পর্যন্ত রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে, সে ঘটনায় ভুক্তভোগীর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনাজনিত কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বোনারপাড়া থানা এলাকায় রেললাইন থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আল আমীন ওরফে নয়নের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা প্রতিবেদনে চিকিৎসক উল্লেখ করেন, রেল দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে।
লাশ উদ্ধারের দিন ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল নয়নের বাবা বাদী হয়ে বোনারপাড়া রেলওয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে রেলওয়ে থানা পুলিশ তদন্ত করে, পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) আসে। রেলওয়ে পুলিশের মতো সিআইডিও এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। কিন্তু বাদীর নারাজি দেওয়ায় আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই রংপুর জেলা ইউনিটকে নির্দেশ দেয়।
পিবিআই তদন্ত করে পেয়েছে, প্রেমের সম্পর্কের জেরে নয়নকে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় সংস্থাটি। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার আত্মীয়স্বজন নয়নকে আটক করে ছুরিকাঘাত করে ও গলা কেটে হত্যা করে।
ট্রেন দুর্ঘটনায় নয়নের মৃত্যু হয়েছে মানুষ যেন তা মনে করে সে জন্য লাশ রেললাইনের ওপর ফেলে রাখে। পিবিআই দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
হোসেন আলী গণমাধ্যম কে বলেন, ‘আমি এক বছর ধরে নিবিড়ভাবে তদন্ত করি ও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করি। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদকালে যে মেয়েটির সঙ্গে নয়নের সম্পর্ক ছিল তার ভাই সব বলে দেয়।’
রাজধানীর চকবাজারের আনিসুর রহমানকে মাথায় আঘাত করে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন তার প্রেমিকা জোসনা বেগম। এর নেপথ্যে ছিল ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি। জোসনা ও তার আরেক প্রেমিক রাজ্জাক পরিকল্পিতভাবে আনিসকে হত্যা করে।
২০১০ সালের এ ঘটনায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসক আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু উল্লেখ করেন। আনিসের ভাই চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বছরের পর বছর পর্যায়ক্রমে চকবাজার থানা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি পৃথক তদন্ত করে আত্মহত্যাজনিত কারণ উল্লেখ করেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবারই বাদী নারাজি দেন।
অবশেষে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। তদন্ত পর্যায়ে পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার রাজ্জাক আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেয়। জোসনা ও রাজ্জাককে অভিযুক্ত করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগ দাখিল করেছে পিবিআই। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
একইভাবে ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে রেললাইন থেকে উদ্ধার হয় খাইরুল ইসলামের মরদেহ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে রেল দুর্ঘটনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। নান্দাইল মডেল থানায় খাইরুলের স্ত্রী শিরিন আক্তারের করা মামলাটি কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে থানা পুলিশ, নান্দাইল মডেল থানা পুলিশ এবং সর্বশেষ ময়মনসিংহ সিআইডি তদন্ত করে কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটি অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই ময়মনসিংহ জেলা।
সংস্থাটি তদন্ত করে জেনেছে, দুর্ঘটনা নয়, খাইরুলকে হত্যা করা হয়েছে পরকীয়া সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। হত্যায় অংশ নেওয়া ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তারা। পিবিআই তাদের অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে।
একই বছর ২৪ অক্টোবর ময়মনসিংহের ত্রিশালের রামপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন সদস্য মোনায়েম খাঁর গলায় ফাঁস দেওয়া ঝুলন্ত মরদেহ বাড়ির পাশের একটি গাছ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ মৃত্যুকেও আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয় ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে। ত্রিশাল থানায় মোনায়েমের বাবার করা হত্যা মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। পরে পিবিআই তদন্তে দেখা গেছে, নির্বাচন ও বিলের পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে খুন হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল ১১ জন। ২০১৯ সালে তদন্ত শেষে ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. ফিরোজ হোসেন গণমাধ্যম কে বলেন, ‘সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদেই রহস্য উদঘাটিত হয়। আসামিদের পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।’
পিবিআইয়ের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, কিছু অপমৃত্যু মামলা পুনঃতদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, পূর্ববর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তারা মামলা তদন্তের ভিত্তি হিসেবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব মামলার ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘সুইসাইডাল নেচার’ বা ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
কিন্তু পিবিআই কর্মকর্তারা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।