৮ শতাংশ সুদে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে প্রবাসীদের জন্য আকর্ষনীয় পেনশনবীমা

Uncategorized অর্থনীতি আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বানিজ্য বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

পেনশন বীমার ধরণ। 


বিজ্ঞাপন

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া নাগরিকদের তাদের জমা দেওয়া চাঁদার বিপরীতে ৮ শতাংশ হারে সুদ দেবে সরকার। তবে বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিলে প্রবাসীরা অতিরিক্ত ২.৫% হারে প্রণোদনা পাবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত করা পেনশন বিধিমালায় এসব বিধান রাখা হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে।

প্রবাসীদের নির্ধারিত সুদহারের বাইরে রেমিটেন্সের মতোন প্রণোদনা দেওয়ায়– তা আরও বেশি বাংলাদেশিকে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। যা এই সংকটকালে দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি করবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সরকারি চাকুরি ও পেনশন ব্যবস্থায় যারা অন্তর্ভুক্ত নন, প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় এমন চারটি শ্রেণিকে যুক্ত করা হচ্ছে। এরা হলেন: বেসরকারিখাতের চাকরিজীবী, প্রবাসী বাংলাদেশি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং অস্বচ্ছল ব্যক্তিসমূহ।
বেসরকারি চাকরিজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন পেনশনের চাঁদার হার জনপ্রতি মাসিক সর্বনিম্ন ১,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অস্বচ্ছল হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তির জন্য মাসিক চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১,০০০ টাকা। এর মধ্যে অস্বচ্ছলদের জমা দিতে হবে ৫০০ টাকা, বাকি ৫০০ টাকা সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে।

অন্যদিকে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য মাসিক চাঁদার সর্বনিম্ন হার ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া, ৭,৫০০ টাকা এবং ১০,০০০ টাকার দু’টি স্কিমও থাকবে প্রবাসীদের জন্য। তবে প্রবাসীদের বিদেশি মুদ্রায় এই চাঁদা দিতে হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হলে ২.৫% হারে প্রণোদনা পাবেন তারা। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী যদি ৫,০০০ টাকার স্কিমে যোগ দেন, তাহলে তার প্রকৃত চাঁদা হবে ৪,৮৭৫ টাকা।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, কেউ যদি ১৮ বছর বয়সে পেনশন হিসাবে ১,০০০ টাকা করে মাসিক চাঁদা জমা শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা জমা দেন, তাহলে অবসরের পর প্রতি মাসে ৬৪,৭৭৬ টাকা হারে পেনশনের টাকা পাবেন।

আবার কেউ যদি ৩০ বছর বয়সে ১,০০০ টাকা করে মাসিক চাঁদা জমা শুরু করেন তাহলে ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর মাসে ১৮, ৯০৮ টাকা করে পাবেন।পেনশনধারী ৭৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা গেলে, তার নমিনি অবশিষ্ট মেয়াদের মাসিক পেনশন পাবে।
এছাড়া, ১০ বছর ধরে চাঁদা দেওয়ার শর্ত পূরণের আগেই কেউ মারা গেলে, মুনাফাসহ তার নমিনিকে জমা অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।

বিদ্যমান আইনের আওতায় ১৮ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারবেন। এবং ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে ৫০ বছরের অধিক বয়সীরাও সার্বজনীন পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভূক্ত হতে পারবেন। তবে অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন না তারা। ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর তারাও আজীবন পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। অর্থাৎ, কেউ ৬০ বছর বয়সে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর ৭০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন।

সার্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুসারে, নাগরিকরা যেকোন সময় সর্বজনীন পেনশনের এক স্কিম থেকে অন্য স্কিম কিংবা চাঁদার পরিমাণ একটা থেকে অন্যটা গ্রহণ করতে পারবেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানায়, বুধবার অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব সিদ্ধান্তসহ সার্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ও সার্বজনীন পেনশন রেজিস্ট্রেশন বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিধিমালা দু’টি আগামী সপ্তাহে পরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

জুলাই থেকে চালু হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা :

আগামী জুলাই মাসে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সময় চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সৌদি আরব বা মালয়েশিয়া প্রবাসী দু’-তিনজন বাংলাদেশিকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত করে তাদেরকে সরাসরি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একইভাবে চার শ্রেণির কয়েকজন নাগরিককেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর আগে আইন অনুসারে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। এই কর্তৃপক্ষ দরকারি বিধিমালা প্রণয়নের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। তবে আগামী মাস থেকেই পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে সরকারের আগ্রহ থাকায়, কর্তৃপক্ষ গঠনের আগেই বিধিমালা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

জনগণের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করতে দেশব্যাপী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এর আওতায় টেলিভিশনে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে পেনশন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি থাকায়, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘সবার জন্য পেনশন’ সুবিধা চালুর বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

অস্বচ্ছল নাগরিক কীভাবে চিহ্নিত করা হবে : অস্বচ্ছল নাগরিকদের সরকার কিভাবে চিহ্নিত করবে, এমন প্রশ্নে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যেহেতু অস্বচ্ছলদের চাঁদার ৫০ শতাংশ সরকার পরিশোধ করবে, তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বচ্ছল পরিবারের অনেকেই এ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেটি মাথায় রেখেই বর্তমানে যারা সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পাচ্ছেন তাদের বাইরে অন্যান্য অস্বচ্ছলদের অন্তর্ভুক্ত করতে একটি সংজ্ঞা বিধিমালায় যুক্ত করা হচ্ছে।

অস্বচ্ছলদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি রয়েছে। যেমন- ভিজিডি ভিজিএফ, টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সহায়তা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি। এসব কর্মসূচির আওতার বাইরে থাকা অস্বচ্ছলদের সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

সরকারি কর্মচারীদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে:

নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতরা বর্তমানে সরকার থেকেই পেনশন, গ্রাচুইটিসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থাই চালু থাকবে। তবে কোন একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন, তাদেরকে এখনকার মতো সরকার থেকে পেনশন পাওয়ার বদলে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনার বিষয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটি ঘোষণা থাকতে পারে।

যেভাবে নিবন্ধন করা যাবে :

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, যারা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে চান, তাদেরকে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। ঘরে বসে সবাই যাতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন, সেজন্য একটি অ্যাপ থাকবে। এছাড়া, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়েও নিবন্ধন করা যাবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে অ্যাপ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন।

রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে প্রত্যেকে একটি ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর পাবেন। সরকার আশা করছে, ১০ কোটি নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সেজন্য ১৮ সংখ্যার ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর দেওয়া হতে পারে।

সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলবে। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে তার নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরে মাসিক চাঁদা দিতে হবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে চাঁদা দিতে পারবেন। আর নিবাসীরা সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে কিংবা বিকাশ, নগদসহ যেকোন মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দাতার মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্টে চাঁদা দিতে পারবেন।

বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধির লক্ষ্য:

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত হতে প্রবাসীরা অধিক আগ্রহী হবে উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দেবে, তাই এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী টিবিএসকে বলেন, “প্রবাসীরা যদি বাড়তি প্রণোদনা পায়, তাহলে বলতে হবে এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। যেসব প্রবাসী বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানিতে চুক্তি-ভিত্তিক চাকরি করে তাদের স্থিতিশীল আয়ের উৎস আছে। এজন্য তারা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আগ্রহী হতে পারে। কিন্তু, যারা ব্যক্তি-পর্যায়ের চাকরি করছে, নিয়মিত আয় না থাকলে তারা এতে আগ্রহী হবে না।”

ঋণ নেওয়ার সুযোগ :

পেনশন তহবিলে জমা সমুদয় অর্থ একেবারে উত্তোলনের কোনো বিধান না থাকলেও, জমা অর্থের ৫০ শতাংশের সমান ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন স্কিমে অন্তর্ভুক্তরা। এই ঋণের অর্থ অবশ্য সুদসহ ফেরত দিতেও হবে। পেনশনের আমানতকে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তা কর রেয়াত যোগ্য হবে। এছাড়া, পেনশনধারীদের মাসিক পেনশন হবে সম্পূর্ণভাবে আয়কর মুক্ত। >২০১৪ সালের এপ্রিলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সর্বজনীন পেনশন চালুর পরিকল্পনার কথা জানান। কিন্তু, সে সময় এই উদ্যোগ খুব একটা এগোতে পারেনি। সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সর্বজনীন পেনশন চালুর প্রতিশ্রুতি দেয়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যা অচিরেই শুরু হতে চলেছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *