নিজস্ব প্রতিবেদক : রহস্যের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া জোড়া খুনের রহস্যভেদ করেছে পিবিআই। ভাতিজা হত্যার দায় চাচার উপর চাপিয়ে চাচাকে প্রথমে পালিয়ে যাওয়া এবং চাচার লাশ পাওয়ার পর আত্নহত্যার অপবাদের নাটক মঞ্চস্থ করে হত্যাকারীরা। ঘটনাটি ঘটে গত ০৬ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ ঢাকার কদমতী থানাধীন “কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস” এর মেসে। এই নাটকীয় জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই।
আজ ২ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১ টায় পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স ধানমন্ডি, ঢাকায় আলোচিত জোড়া খুনের এই রহস্য উদঘাটন সংক্রান্তে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুদার, বিপিএম (বার), পিপিএম।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পিবিআই এর ডিআইজি (পূর্বাঞ্চল) মোর্শেদুল আনোয়ার খান, ডিআইজি (পশ্চিমাঞ্চল) মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, বিপিএম, পিপিএম, পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, পিপিএম এবং পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএম এর বক্তব্য অনুযায়ী জানা গেছে, ভিকটিম সোহেল মিয়া টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। ভিকটিম সোহেল প্রতিবেশি চাচা আসামী ইকবাল হোসেন সহ ঢাকার কদমতলী থানাধীন “কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস” এ চাকুরি করত। উক্ত এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী মোঃ হাসান মিয়া ইকবালে স্ত্রী পারভীন বেগম (৪০) এর মোবাইলে ফোন করে জানায় যে, গত ৬ নভেম্বর ১৭ তারিখ রাত ৩ টায় “কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস”এর মেসে ভিকটিম ইকবাল তার প্রতিবেশি ভাতিজা সোহেলকে লোহার রড দিয়ে মারপিট করে আহত করে পালিয়ে গেছে। প্রেসের মালিক ও কর্মচারীরা সোহেলকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পান্তপথ ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনায় সোহেলের ছোট ভাই মোঃ সাইদুর রহমান (২৮) বাদী হয়ে আসামী ইকবাল (৫৫) এর বিরুদ্ধে কদমতলী থানার মামলা নং-১৮, তারিখঃ ০৭/১১/২০১৭, ধারা-৩০৭/৩২৫/৩৪ পেনাল কোড আইনে মামলা দায়ের করেন।
কদমতলী থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৮ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ সোহেল মারা গেলে ভিকটিম সোহেলের ছোট ভাই বাদী মোঃ সাইদুর রহমান (২৮) আদালতে আবেদন পূর্বক তার দায়েরকৃত মামলায় পেনাল কোড আইনের ৩০২ ধারা সংযোজন করেন।
সোহেল হত্যা মামলার এজাহার ভুক্ত আসামী ভিকটিম ইকবাল এবং সোহেল সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। তারা একই সাথে প্রেসে চাকুরি করত এবং রাতে এক সাথেই প্রেসের মেসেই থাকত। গত ০৬ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ রাত ৩ টায় লাইট বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে ভিকটিম সোহেল (ভাতিজা) এবং আসামী ভিকটিম ইকবাল (চাচা) এর মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসামী ভিকটিম ইকবাল (চাচা) প্রেসে থাকা লোহার ভারী পাত দিয়ে মাথায় আঘাত করে আহত করে। সোহেলের চিৎকারে প্রেসে থাকা অন্যান্য কর্মচারীরা লাইট অন করলে আসামী মোঃ ইকবাল লোহার পাত হাত থেকে ফেলে দিয়া দৌড়ে পালিয়ে যায়।সোহেলকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পান্তপথ ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোহেল ৮ নভেম্বর ২০১৭ সালে মারা যায়।
তদন্তকালে থানা পুলিশ সোহেল হত্যার মামলার বাদীর মাধ্যমে জানতে পারেন যে, মামলার এজাহার ভুক্ত পলাতক আসামী ভিকটিম ইকবাল নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জের বরপা বিক্রমপুর ষ্টিল মিলের বাউন্ডারী ওয়ালের পার্শ্বে গাছের সাথে গলায় গামছা পেচিঁয়ে ফাঁসিতে ঝুলে আত্নহত্যা করেছে। সোহেলের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর মেসের অন্যান্য কর্মচারীরা নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করে যে, আসামী মোঃ ইকবাল কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে নিজ অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে নারায়নগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন বরপা বিক্রমপুর ষ্টিল মিলের বাউন্ডারীর ওয়ালের পার্শ্বে গাছের সাথে গলায় গামছা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে আত্নহত্যা করেছে।থানা পুলিশ আসামী ইকবাল আত্নহত্যা করে মৃত্যুবরন করায় তাকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি চেয়ে ২৭ জানুয়ারী ২০১৮ সালে মামলাটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য আদালতে দাখিল করে এবং কোন তদবীর না থাকায় আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা নথিযাত করে।
রূপগঞ্জ থানা পুলিশ সোহেলের চাচা ভিকটিম ইকবালের মোবাইল থেকে তার পরিবারের লোকজনকে ফোন করে জানায় যে, নারায়নগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন বরপা বিক্রমপুর ষ্টিল মিলের বাউন্ডারীর ওয়ালের পার্শ্বে গাছের সাথে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ইকবালের লাশ পাওয়া গেছে। সংবাদ পেয়ে ভিকটিমের স্ত্রী এবং ভাতিজা রুপগঞ্জ থানায় গিয়ে ভিকটিম ইকবালের অর্ধগলিত লাশ সনাক্ত করে। ভিকটিম ইকবালের মৃত্যু সংক্রান্তে রুপগঞ্জ থানার অপমৃত্যু মামলা নং-২২/১৭, তারিখঃ ১২/১১/২০১৭ রুজু হয়। মৃতদেহের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা উল্লেখ থাকায় ভিকটিম ইকবালের স্ত্রী বাদী হয়ে প্রেসের ১০ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে রুপগঞ্জ থানার মামলা নং-২৭, তারিখঃ ১১/০২/২০১৮ইং দায়ের করলে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারনামীয় ১-৬ নং আসামীদেরকে গ্রেফতার করেন। থানা পুলিশ তদন্ত করাকালে পুলিশ সুপারের নির্দেশে সহকারী পুলিশ সুপার ‘গ’ সার্কেল নারায়ণগঞ্জ মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি পূর্বে গ্রেফতারকৃত আসামী ছাড়াও প্রেসের আরো ২ জন কর্মচারীকে গ্রেফতার করেন। তদন্ত চলাকালীন ২২ মে ২০১৮ তারিখ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এর নির্দেশে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।
পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জমান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি পূর্বের গ্রেফতারকৃত এজাহার বহির্ভূত আসামী জাহানুর ও মোঃ জামালদের পুলিশ রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা কোনো তথ্য দেয় নাই। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে মামলার বিষয়ে আলোচনায় তিনি দিক নির্দেশনা পান যে, আসামীরা কোনো গাড়ীর সাহায্যে লাশটি রুপগঞ্জের বরপায় নিয়ে যেতে পারে। তদন্তকারী দল ঐ ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা ও ড্রাইভিং কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এলাকায় কয়েকটি গাড়ীর চলাচল সন্দেহ হওয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ধোলাইখাল হতে একটি গাড়ীসহ মোঃ নুর আলম (৩৫), পিতা-মৃত জিন্নাত আলী তালুকদার, মাতা-মোসাঃ সোনাবানু, সাং-৬নং পশ্চিম ধোলাইপাড়, ডাকঘর-গেন্ডারিয়া, থানা-শ্যামপুর, জেলা-ঢাকা। বর্তমান সাং-দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী দেওয়ানপাড়া, বাড়ী নং-২৬২, মৃত ইউনুছ হাজীর বাড়ীর ভাড়াটিয়া, থানা-যাত্রাবাড়ী, জেলা-ঢাকাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান যে, ২০১৭ সালে তিনি মোঃ বাদল মিয়ার পিকআপ চালাতেন। তিনি বাদলকে পিকআপসহ আসতে বললে বাদল তা করে। নূরু গাড়িটি এবং মালিক বাদলকে সনাক্ত করে। নূরু ও বাদলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা লাশ গুম করার কথা স্বীকার করেন এবং প্রেসের কর্মচারীগণ কর্তৃক হত্যাকান্ডের তথ্য দেন। লাশ গুমের কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করেছে জামাল, মামুনসহ মোট ৭ জন। তাদের ২ জনকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা স্বেচ্ছায় আদালতে ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি প্রদান করে। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দ্বারা ২ টি জোড়া খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়।
জোড়া খুনের নেপথ্যের ঘটনা হলো, ভিকটিম ইকবাল পরহেজগার ছিল এবং ভোরে ঘুম থেকে উঠত এবং রুমের লাইট জ্বালাতো। রুমের লাইট জ্বালিয়ে রাখা নিয়ে অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ঘটনার দিন গত ০৬ নভেম্বর ২০১৭ সালে রাত ৩ টায় প্রথমে এজাহার ভুক্ত আসামী আঃ রহমান এর সাথে ঝগড়া, হাতাহাতি ও মারপিট হয়। অন্যান্য কর্মচারীরাও মারপিটে যুক্ত হয়। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের ফলে তারা সকলে মিলে ইকবালকে মারপিট ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তখন তার প্রতিবেশী ভাতিজা সোহেল তার চাচা (ভিকটিম ইকবাল) কে রক্ষা করতে গেলে আসামীরা তাকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাথারীভাবে মারপিট করে আহত করে। এজাহার বহির্ভুত আসামী জামাল তার পূর্ব পরিচিত পিকআপ ড্রাইভার নূর আলম (৩৫) এবং গাড়ির মালিক বাদল এর সাথে কথা বলে ২০ হাজার টাকায় পিকআপ ভাড়া করে। পিকআপ মালিক বাদল এবং ড্রাইভার নূর আলম পিকআপটি প্রেসে নিয়ে আসে। তারা ৬ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে লাশটি গাড়ীতে ওঠিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জের বরপায় নিয়ে গিয়ে লাশের গলায় গামছা পেঁচিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জের বরপা বিক্রমপুর ষ্টিল মিলের বাউন্ডারী ওয়ালের পার্শ্বে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখে।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জমান তার তদন্ত থেকে প্রাপ্ত তথ্য ভিকটিম সোহেল (কদমতলী থানার মামলা নং-১৮, তারিখঃ ০৭/১১/২০১৭ এর ভিকটিম) হত্যা মামলার জানানোর মাধ্যমে মামলাটি (কদমতলী থানার মামলা নং-১৮, তারিখঃ ০৭/১১/২০১৭) পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাবস্থা করা হয়। আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিলে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) মামলাটি তদন্ত করে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) সোহেল হত্যা মামলায় জড়িত আসামীদের গ্রেফতার ও শোন এরেস্ট করে। এই মামলায় মামলায় পিকআপ মালিক, পিকআপ ড্রাইভার, এবং প্রেসের মালিক আসামী নয়। ২ টি মামলাতেই দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।