উদ্বেগজনক হারে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে শিশুরা সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে— ইউনিসেফ 

Uncategorized জাতীয় জীবন-যাপন বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক :  উদ্বেগজনক হারে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে শিশুরা সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে ইউনিসেফ এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইউনিসেফ কিছু পরামর্শ ও দিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সয় সংশ্লিষ্ট সকল অংশীদার ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সমুহ কে।


বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ফাহিম তার মায়ের পাশে বিছানায় শুয়ে আছে। আর নার্সরা তার জ্বর কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত নয় দিন ধরে ফাহিম  এই জ্বরে ভুগছে।


বিজ্ঞাপন

“আমার সারা শরীর ব্যথা করছে। এই অবস্থায় চলাফেরা করা বা অন্য কিছু করাও কঠিন,” হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস করতে না পারায় দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলে ফাহিম।

এগারো বছর বয়সী ফাহিম স্থানীয় একটি মাদ্রাসার  ছাত্র। তার মাদ্রাসার কাছে জমে থাকা পানিতে জন্ম বিস্তার করেছে এডিস মশা; ধারণা করা হয়, এই মশার কামড়েই ফাহিম ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।

ফাহিমের অবস্থার অবনতি হলে তার মা জেসমিন জ্বরের উপসর্গগুলো বুঝতে  পারে এবং  তাকে গাজীপুরের টঙ্গীতে শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে মেডিকেল স্টাফ ও নার্সরা তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেন।

“ফাহিমের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তবে তাকে আরও আগে ভর্তি করাতে পারলে ভালো হতো। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেক রোগী ভর্তি হওয়ার কারণে ভর্তির লাইন  অনেক লম্বা,”- জেসমিন হাত দিয়ে ছেলের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে করতে বলেন।

 ডেঙ্গু একটি সামাজিক সংক্রামক সংকট : 

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরায় এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা দেশজুড়ে শিশু ও কমিউনিটিগুলোকে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মত বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ডেঙ্গুর মতো রোগের বিস্তারকে আরও বাড়িয়ে তোলে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু দেশের ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়ে পড়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার এবং ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু এই দুই  সংখ্যাই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যা শিশুদের জন্য একটি বড় হুমকি তৈরি করেছে।

ডিজিএইচএসের তথ্য আরও বলে যে, আক্রান্তদের ২৯ শতাংশই শিশু, সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় যে হাজার হাজার শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, ফাহিম তাদের একজন।

প্রতিরোধের মাধ্যমে কমিউনিটিগুলোকে রক্ষা করা :

যে হাসপাতালে ফাহিমকে ভর্তি করা হয়েছে তা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা ও সহায়তা প্রদানের জন্য টঙ্গীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সকল রোগী ও তাদের পরিবারকে নিজ নিজ কমিউনিটিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রশমিত করার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করছে।

১১ বছর বয়সী ফাহিম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় তার মা জেসমিন তার সঙ্গে ছিলেন।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ তারিক হাসান বলেন, “আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা রোগীদের তাদের বাসস্থান ও আশেপাশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবং এর বিস্তার কমাতে যা করণীয়  সে সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি। পাশাপাশি তারা তা অনুসরণ করছে কিনা তা জানার চেষ্টা করি।”

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে হাসপাতালটির কার্যক্রম প ইউনিসেফের ঝুঁকি যোগাযোগ ও কমিউনিটি সম্পৃক্ততা (রিস্ক কমিউনিকেশন ‍এন্ড কমিউনিটি এন্গেজমেন্ট/আরসিসিই) উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যার লক্ষ্য হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কমিউনিটিগুলোকে ক্ষমতায়ন করা।

বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য পাটনারদের (অংশীদারদের) সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে ইউনিসেফ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় অক্লান্ত কাজ করে চলেছে, যেখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে আরসিসিই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা। এর মধ্যে রয়েছে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করা সহ/ বিভিন্ন উপায়ে জীবন রক্ষাকারী বার্তা প্রচার করা।

জনসাধারণের কাছে সঠিক ও কার্যকরী তথ্য পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ধর্মীয় ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকেও যুক্ত করছে ইউনিসেফ। ডেঙ্গুর বিস্তার কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে তরুণদের পরিবর্তনের দূত (চেন্জমেকার) হিসেবে তাদের কমিউনিটিতে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

ঢাকার বনানীতে একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় ধর্মীয় নেতারা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের কমিউনিটিতে কথা বলেন।

ভবিষ্যতে ডেঙ্গু যাতে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম প্রয়োজন। ইউনিসেফ স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরে (পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন) দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য অংশীদারদের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সক্ষমতা তৈরি করা থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান এবং গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী সরবরাহ করা, সবই রয়েছে ।

পরিবর্তনের জন্য সহযোগিতা :

ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে ফাহিমের লড়াই আরেকবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এখনই সময় সবাইকে এক হয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। ইউনিসেফ, ঝুঁকিপূর্ণ কমিউনিটিগুলো, বিশেষ করে শিশুদের ওপর ডেঙ্গুর প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য অংশীদারদের সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াই হলো একটি ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, যেখানে সংক্রমণের শিকল ভাঙতে এবং সবার জন্য আরও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *