রফিকুল ইসলাম সাগর : গিয়েছিলাম হবিগঞ্জে। সেখানের একটি স্ট্যান্ডে সেদিন যাত্রীর প্রচুর চাপ ছিল, কিন্তু সেই তুলনায় ভাড়ায় চালিত সিএনজি অটোরিক্সার সঙ্কট। সেই সুযোগকে পুঁজি করে চালকরা ৮০ টাকার ভাড়া ১৫০ টাকা নিচ্ছিলেন। যাত্রীরা নিরুপায়। যেতে হলে ১৫০ টাকাই দিতে হবে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, স্ট্যান্ডে একটি সিএনজি আসার পর যাত্রী নামানো মাত্রই নতুন করে যাত্রী উঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ধাক্কা-ধাক্কি বেঁধে যায়, কে আগে উঠবে। ভাড়া ডবল কেন তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে আমাকেও যেতেই হবে। তাই বাধ্য হয়েই ধাক্কা-ধাক্কি করে একটি সিএনজি অটোরিক্সায় উঠলাম।
ধাক্কা-ধাক্কি করে আমি যে সিএনজি অটোরিক্সায় উঠলাম তার চালক চলতি পথে কথায় কথায় বলল, ‘দেশটা লুটতরাজ, দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজে ভরে গেছে।’ – আমি বললাম, আপনি যে ৮০ টাকার ভাড়া ১৫০ টাকা নিচ্ছেন। আপনারা নিজেই তো মানুষের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে টাকা নিচ্ছেন। আগে আপনি ঠিক হোন।
আমার কথা শুনে চালক মুখস্থ বানী শুনিয়ে দিলেন – ‘তিন ঘন্টা বসে থেকে টিপ নিয়ে এসেছি। আবার গিয়ে তিন ঘন্টা বসে থাকতে হবে। কি করব বলেন!’ প্রতিনিয়ত তাদের এধরনের অযুহাতের কাছে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি। শুধু হবিগঞ্জে নয় সারাদেশে সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের সিন্ডিকেটে জিম্মি সাধারণ মানুষ।
পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখেছি পুরো হবিগঞ্জ জুড়ে বিশেষ দিন গুলো এলেই ভাড়া বাড়িয়ে নেয় সিএনজি ও ইজিবাইক চালকরা। কারন হিসেবে তাদের সবার ‘তিন চার ঘণ্টা বসে থেকে সিরিয়াল পাওয়ার একই অযুহাত। যদিও আসল কারণ তা নয়। দরকষাকষি করে যে কম ভাড়ায় অন্য সিএনজি তে যাবেন সেই সুযোগ-ও নেই। সবাই এক সিন্ডিকেট! পুরো স্ট্যান্ডে ভাড়ার রেট এক হয়ে যায়। কোনো চালক যদি কম ভাড়ায় যেতে রাজিও হয়। অন্যসব চালকেরা তাকে ঘিরে ধরবে। কম ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে যেতে দিবে না।
এভাবেই চলে। তাদের ব্যপক ক্ষমতা। কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করে ঝগড়ায় জড়ালে তার রক্ষা নেই। একবার এমন ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েছিলাম। প্রায় বছর খানেক আগের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোড থেকে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার মোড়াকড়ি যাওয়ার পথে। সেদিন ছিল একটি বিশেষ ছুটির দিন। ছুটির দিন পেলে শহর থেকে মানুষ গ্রামে ছুটি কাটাতে যায়। তাই যাত্রীদের বাড়তি চাপ ছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিএনজি চালকরা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্বরোড থেকে মোড়াকড়ি পর্যন্ত সবাই নিচ্ছিল জনপ্রতি ১০০ টাকা। সেখানে এক চালক আমাদের ৮০ টাকায় নিতে রাজি হলেন। কিন্তু তাতে বাঁধলো বিপত্তি। আমরা অটোরিক্সায় উঠে বসার পর অন্য ৭-৮ জন সিএনজি চালক আমাদের চালককে ঘিরে ধরেছে। তাকে যেতে দিবে না। বলছে তার নাকি সিরিয়াল এখন না। একজন চালকের সাথে একে একে স্ট্যান্ডের সব চালকরা জড়ো হয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে। একদিকে সব চালকরা আমাদের বলছে, ‘আপনারা নামেন, এই সিএনজি যাবে না।’
অন্যদিকে আমরা যেটায় বসেছি তার চালক আমাদের বলছে, ‘আপনারা নামবেন না। বসে থাকেন।’ এক পর্যায়ে সকলের হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করেই সেই চালক আমাদের নিয়েই সিএনজি ছাড়লেন। কিন্তু ঝগড়া এখানেই শেষ হলো না। স্ট্যান্ডের সব চালকরা তাদের সিন্ডিকেটের অন্য চালকদের ফোন করে জানিয়ে দেন সামনের স্ট্যান্ডে আমাদের বহনকারী সিএনজিটাকে আটকাতে। নাসিরনগর নামক জায়গায় যাওয়ার পর দেখলাম একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সিএনজি থামিয়ে আমাদের নামিয়ে দিলো।
আমরা নামতেই তাদের কয়েকজন সিএনজিতে উঠে বসে চালককে ধরে নিয়ে গেল। এই খবর আটককৃত চালকের গ্রামে ছড়িয়ে পড়তেই সেই গ্রামের সিএনজি চালকরা জোট বেঁধে তাদের গ্রাম দিয়ে যাওয়ার সময় নাসিরনগরের সিএনজি চালকদের আটক শুরু করে। শুনেছি এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ চলে টানা দু’তিনদিন। জেলা, উপজেলা প্রশাসন সিএনজি অটোরিক্সা ও ইজিবাইক চালক, মালিক সমিতির সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও তা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বাস্তবে যাত্রীদের জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে সিন্ডিকেটের ক্ষমতার কাছে হার মানতে হয়। তাদের এই সিন্ডিকেট ভাঙার কেউ কি নেই? ( লেখক : একজন সাংবাদিক)
Post Views: 686