আবর্জনার সাথে বসবাস

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা রাজধানী

বিশেষ প্রতিবেদক
আবর্জনার ভাগারে পরিনত হয়ে পড়ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। আবর্জনা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলতে বাধ্য হচ্ছে রাজধানীবাসী। কামরাঙ্গীরচরের জাউলাহাটির হাজির ঘাট এলাকায় আবর্জনা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। এলাকাবাসী খোলা একটি জায়গায় ঘরবাড়ির দৈনন্দিন ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। বৃষ্টি হলে তা আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশে। পরিবেশ হচ্ছে দুর্গন্ধময়। এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ময়লা সংগ্রহের জন্য সিটি করপোরেশন এখানে গাড়ি পাঠায় না। তাই রাস্তার পাশে ময়লা ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, ময়লার গন্ধে টেকা যায় না। বাড়িওয়ালারাও কোনো উদ্যোগ নেয় না, আর কমিশনার তো ভুলেও এদিকে আসে না।
এক নারী বলেন, সবাই এইখানে ময়লা ফালায়, আমিও ফালাই। সমস্যা কী? সবাইরে বন্ধ করতে কন, আমিও ফালামু না।
স্থানীয় মোহাম্মদ সিকান্দার বলেন, কয়েক মাস আগেও রাস্তার মোড়ে সবাই ময়লা ফালাইত। গন্ধে এমন অবস্থা হইতে যে আশেপাশে মানুষ ঘুমাইতেও পারত না। পরে আমরা সবাই মিলে জায়গাটা পাল্টাই। এখন সবাই এই সাইডে ময়লা ফালায়। কিন্তু তাও অনেক দিন ধইরা ময়লা ফালানোর কারণে, প্রচুর ময়লা জমছে, গন্ধও অনেক।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরে আলম বলেন, এলাকাটা সিটি করপোরেশনে গিয়েছে নতুন। এখানে অনেক কাজ বাকি আছে। অনেক জায়গায় রাস্তা পুরোপুরি নাই। সে ক্ষেত্রে লোকজন কিছুটা এগিয়ে আসলেই ময়লার গাড়িতে ময়লা দিতে পারে। কিন্তু তারা তা দিতে চায় না। তারা এক জায়গায় ময়লা ফেলে।
ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শন আরিফুল ইসলাম বলেন, ময়লা গাড়িতে দিলে মাস শেষে টাকা দিতে হয়। টাকা খরচ করতে চায় না, এই ময়লা ফেলতে ফেলতে স্তূপ করে ফেলেছে।
এই এলাকাটির চিত্র আর নগরীর সামগ্রিক চিত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে কিছুটা। তবে যে কোনো এলাকায় এমনকি অভিজাত আবাসিক এলাকাতে কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখার দৃশ্য পীড়া দেয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা সময় নাগরিক অসচেতনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে পরিস্থিতি গত এক দশকে পাল্টেছে কমই।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, নগরীতে যখন যথাপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করবেন তখনই আপনি প্রত্যাশা করতে পারেন যে, জনগনকে বললে জনগণ যেখানে যেখানে ময়লা ফেলবে না। উপযুক্ত পরিবেশ, ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের যে একটি নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট থাকার কথা, সেটাও এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিতভাবে পাওয়া যায়নি।
নগরবাসীর যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলার পেছনে ব্যবস্থাপনার দায় আছে বলেও মনে করেন এই পরিবেশ আন্দোলনকারী। তিনি বলেন, আপনি কি মনে করেন সিঙ্গাপুরের মানুষরা ফেরেশতা? তারা বেহেশত থেকে আসছে? তারা আমাদের মতো মানুষ। আমার দেশের লোকেরা যখন সিঙ্গাপুরের যায়, তখন তারা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে না। আইনের প্রয়োগটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলার বদভ্যাসে ভুগছে মানুষ নিজেই। পয়ঃনিষ্কাশন নালাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, বৃষ্টির দিন নামনে পারে না পানি। দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এমনকি পয়ঃনিষ্কাশন নালাগুলোও প্রায়ই ভরে যায়। আর নোংরা পানিতে সয়লাব হয়ে যায় বিভিন্ন এলাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মঞ্জুর হোসেন বলেন, নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলতে এবং রাস্তা, ফুটপাত পরিচ্ছন্ন রাখতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন সময় র‌্যালি করেছি এবং বাসা-বাড়ি থেকে যারা ময়লা নেয় তাদের মাধ্যমে আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি।
ডিএনসিসি এলাকার ফুটপাতে বা রাস্তায় ময়লা এবং রাবিশ রাখা হলে প্রথমে আমরা তাদের সতর্ক করি এবং ময়লা সরিয়ে নিতে নোটিশের মাধ্যমে সময় বেঁধে দেই। পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ময়লা সরিয়ে না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ ধরনের ঘটনায় অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বাড়ির প্যাসেজ নাকি ময়লার ভাগাড়
বিভিন্ন আবাসিক এলাকাতে দুই সারি বহুতল ভবনে মাঝখানে ফাঁকা জায়গা বা প্যাসেজে আবর্জনা ফেলে রাখার দৃশ্যটি দৃষ্টিকটূ বটে। তবে নির্ধারিত জায়গায় আবর্জনা ফেলার বদলে জানলার ফাঁক দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার বদভ্যাস থেকে যে মানুষ মুক্ত হতে পারছে না, সেটা বিভিন্ন এলাকা দিয়ে হাঁটার সময় বের হওয়া দুর্গন্ধই বলে দেয়।
ঢাকা উত্তরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড, সলিমুল্লাহ রোড, শেরশাহ সূরি রোড, কাটপট্টিসহ বেশ কিছু এলাকায় এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্গন্ধ নাকে আসে।
দীর্ঘদিন ধরে ময়লা ফেলার কারণে পেসেজ হয়ে উঠেছে ময়লার ভাগাড়। আর ময়লার স্তূপ দেখে সেখানে ময়লা ফেলে যায় ফেরিওয়ালা ও দোকানদাররা। ফলে দিন দিন পেসেজগুলো হয়ে উঠছে দূর্গন্ধময়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র আলেয়া সারোয়ার ডেইজি বলেন, আমি পেসেজগুলো পুনরায় পরিষ্কারের একটি উদ্যোগ নিয়েছি। এক্ষেত্রে স্থানীয় বাড়ি মালিকদের সমন্বয় করে পেসেজগুলো পরিষ্কার করা হবে। সেই সাথে পেসেজগুলো যেন আর এমন ময়লার স্তূপ না হয়, সে বিষয়েও আমরা কড়া নির্দেশনা দেব।
খাল যেন ময়লার স্তূপ
ময়লার ফেলার এক সহজতর জায়গা হয়ে উঠেছে পয়ঃনিষ্কাশন খাল। রাজধানীর মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকার রামচন্দ্রপুর খালে নিয়মিত ময়লার স্তূপ জমে। স্থানীয়দের সচেতনার ফলে খালে ময়লা ফেলা বন্ধ বন্ধ হচ্ছে না। বরং খাল পাড়ের বাসিন্দা, দোকানদার, ফেরিওয়ালাদের ময়লা ফেলার ঠিকানা এই খাল।
খালের আদাবর, নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হাউজিং, চাঁদ হাউজিং, কাটাসুর, রায়েরবাজার এলাকায় সারা বছরই খালের ময়লার উপর ময়লার আবরণ চোখে পড়ে। ময়লার আবরণ এতোটাই পুরু হয় যে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ওই ময়লার উপর দিয়ে অনায়াসে হেঁটে যেতে পারে। ময়লার কারণে ব্যাহত হয় খালের পানির অবাধ প্রবাহ।
ময়লার উপরের অংশে জমে থাকা পলিথিন ও কর্কসিটে কুয়াশা ও বৃষ্টির পানি জমে মশার জন্ম দেয়। একই সাথে ময়লা পচা তীব্র গন্ধ তো রয়েছেই।
একই দশা রাজধানীর অন্যান্য খালগুলোর। কিছুদিন আগেই মিরপুর খালের ময়লার বিশাল স্তূপ পরিষ্কার করেছে ডিএনসিসি। এ ছাড়া মিরপুর খাল, সাংবাদিক কলোনি খালসহ সকল খালের চিত্র একই।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, পরিস্থিতি আমাদের জনগণকে একটি অভিশপ্ত চক্রের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। জনগণ এর সম্ভাবনা এবং প্রয়োজনীয়তা শুকনোর দিনে বোঝে না। জনগণ ও এই নর্দমা এবং নালার মতো করে এগুলোকে তারা ময়লা ফেলার ভাগাড় মনে করে।’
হাসপাতালের পাশেও একই চিত্র
রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন এলাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ময়লা ফেলার জন্য একটি ডাস্টবিন রয়েছে। ডাস্টবিনটি হাসপাতালের ভেতরের দিকে থাকলেও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সে ময়লার কাজ করেন পাশের ফুটপাতে। ফলে স্থানীয়দের চলাচলে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র দূর্ভোগ।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই হাসতাপালের দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাতে ময়লার কাজ করা হয়। ফলে ফুটপাতের এ অংশ দিয়ে চলাচল করা যায় না। আর ময়লার একটি অংশ গড়িয়ে চলে আসে মূল সড়কে। বৃষ্টির পানির সাথে ময়লা মিশে সৃষ্টি করে দূর্গন্ধ।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *