নিজস্ব প্রতিনিধি : সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ম অবমাননার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটিয়ে ধর্মান্ধ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে কিছু স্বার্থান্বেষী লোকজন। দাঙ্গা হাঙ্গামার মাধ্যমে বিনষ্ট হচ্ছে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমুজ্জ্বল ইতিহাস। অথচ ইসলাম হচ্ছে শান্তি ও মানবতার প্রতীক।
অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীর প্রতি সহনশীলতা হচ্ছে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনা। যারা তা লংঘন করে, ফিতনা ফ্যাসাদ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের ব্যাপারে রয়েছে কঠোর শাস্তির আদেশ।
পবিত্র কোরআন এর বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ তা’লা ও হাদিস শরীফে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (দ:) এ সংক্রান্তে সুস্পষ্ট ভাবে বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
মহান আল্লাহ তা’লা সুরা বাকারার ২৫৬নং আয়াতে ঘোষণা করেন “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই”। ধর্ম হচ্ছে মানুষের বিবেক ও বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়।
জোরপূর্বক কারো অন্তরে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে মহান আল্লাহ তা’লা ধর্মকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুরা কাফিরুনের ৬ষ্ঠ আয়াতের মাধ্যমে।
এই আয়াতে বলা হয়েছে “তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার”। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসের প্রতিও আল্লাহ সুষ্পষ্টভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ তা’লা সূরা আনআম’র ১০৮নং আয়াতে বলেন, “আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা (মূর্তিপূজক) ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহ তায়ালাকেও গালি দেবে”।
ব্যবহারিক জীবনে আল্লাহ বিবাদ বিসম্বাদের আত্মঘাতি প্রবণতার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন এই বলে, “যে অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করল এবং যে কারো জীবন রক্ষা করল সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করল” (সুরা মায়েদাহ আয়াত নং ৩২)। বিনা কারণে কোন মুসলমানকে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনিভাবে অন্যায়ভাবে কোন অমুসলমানকে হত্যা করাও হারাম।
আবার আল্লাহ তা’লা সুরা বাকারায় ঘোষণা দিয়েছেন, “ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা হত্যার চেয়েও ভয়াবহ” (সুরা আল বাকারাহ, আয়াত নং ১৯১)।
মানুষের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারকে রাসুল (সা.) সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন বিভিন্ন হাদীসের মাধ্যমে।
যেসব অমুসলমান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বসবাস করে তাদের সুরক্ষা এবং জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দুরত্ব থেকেও পাওয়া যায়” (বুখারি, হাদিস নং ২৯৯৫)।
ইসলামের ইতিহাসে মদীনা সনদ একটি মানবাধিকার সম্পর্কিত অনন্য দলিল।
মদীনা সনদের নির্যাস হলো— ‘মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না’।
মদীনা সনদেও বলা হয়েছে— ‘স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তার জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না’।
মদীনা সনদের ন্যায় বিদায় হজ্জ্বের ভাষণও এক্ষেত্রে প্রনিধাণযোগ্য। মহানবী (সা.) বলেন “সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে”।
তিনি সবাইকে ভাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন, “তোমরা ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া ও রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। তোমরা একে অপরের ভাই”।
তিনি তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, “হে মানববৃন্দ! কোন দুর্বল মানুষের উপর অত্যাচার করো না, গরীবের উপর অত্যাচার করো না। অমুসলিমদের সঙ্গে কখনো নিপীড়নমূলক আচরণ করা যাবে না। তাদের অধিকার খর্ব করা যাবে না”।
এমনকি কেয়ামতের দিন রাসুল (সা.) নিজেই নির্যাতিত অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বিচার চাইবেন।
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত অমুসলিমকে নির্যাতন করে, তার অধিকার খর্ব করে, তাকে সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয় বা তাদের অসম্মতিতে ধন সম্পদ হরণ করে নেয়, কেয়ামতের দিন আমিই সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব” (আবু দাউদ, হাদিস নং ২৫০৩)। মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম।
অতএব আমরা কোরআন, হাদিস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, নিরাপত্তার সাথে বসবাসের অধিকার ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত।
এ অধিকার নিশ্চিত করা প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক কর্তব্য ও ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। তাই অমুসলিমদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা, তাদের নির্যাতন নিপীড়ন করা এবং তাদের উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না।
এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ বন্দর নগরীর ধর্মপ্রাণ সকল নাগরিক এর নিকট থেকে সবসময় দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থান এই নগরীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।
তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে যে কোন ধরনের মিথ্যা তথ্য বা গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি বজায় রাখার অনুরোধ করা হচ্ছে।
এছাড়াও যে কোন ধরনের মিথ্যা উষ্কানি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর বা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন।
জরুরী প্রয়োজনে যোগাযোগ করুনঃ নিকটস্হ থানা, জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ অথবা ০১৩২০০৫৪৪৯৪, ০১৩২০০৫২১১১ মোবাইল নাম্বারে।