সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন

থামছে না বাসে বাসে রেষারেষি
শৃঙ্খলা আনাই চ্যালেঞ্জ বলেছেন মন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাসের বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা দেখা যায় হরহামেশা। একই রুটের বিশেষ করে একই পরিবহনের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এর কারণ পেছনের গাড়ির আগে গন্তব্যে পৌঁছালে ট্রিপ আগে পাওয়ার প্রতিযোগিতা। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্টপেজগুলোতে আগে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা রয়েছে বাসগুলোর মধ্যে। সেখানে আগে পৌঁছাতে পারলে বেশি যাত্রী পাওয়া যায় এমন সম্ভাবনা থেকে তারা এ কাজটি করে বলে জানা যায়। এতে ওভারটেকিং করে এক বাসের পেছন থেকে সামনে যাওয়া বা স্টপেজ থেকে আগে ছেড়ে যেতে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা রাজধানীতে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনায় গাড়ির গ্লাস ভাঙছে, যাত্রীর হাত কাটছে, মাথায় আঘাত পাওয়ার মতো দুর্ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা আনাই চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত সড়ক ভবন মিলনায়তনে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২১ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, পরিবহন ও সড়কে শৃঙ্খলার বড় সঙ্কট রয়েছে। দেশে এত রাস্তা, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, সীমান্ত সড়ক, মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ হচ্ছে। তারপরও আমরা কেন সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারবো না।
তিনি বলেন, কখনও দুই পরিবহনের সংঘর্ষে, কখনও তিন চাকার গাড়ি ইজিবাইক, নসিমন-করিমন দুর্ঘটনায় লোকজন প্রাণ হারায়। এর জন্য আমরা ২২ সড়কে এগুলো নিষিদ্ধ করেছি। কিন্তু অনেক জায়গায় এই নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে না। আর ইদানিং নতুন উপদ্রব হচ্ছে মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল কোনো নিয়ম মানে না। প্রতিদিন সড়কে যে দুর্ঘটনা হয়, বেশির ভাগই মোটরসাইকেল। দুইজন তিনজন চড়ে হেলমেট নাই। সেটা আমার চেষ্টা করে চালকদের হেলমেট পড়তে বাধ্য করেছি। এখন সবাই মোটরসাইকেল চালাতে নিয়ম মানে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, মাঝে মাঝে দেখা যায়, অনেকে নিয়ম মানছে না। তারা রাজনৈতিক কর্মী ও তরুণ-তুর্কি। কিছু রাজনৈতিক কর্মী আছে, তারা একসঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে মোটরসাইকেল চালায়। তিনজন করে বসে, মাথায় হেলমেট নেই। বোঝা যায় তারা দাপট দেখাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিয়ম মানে। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় দেখি সব মোটরসাইকেল চালক হেলমেট পরে যাচ্ছে।
সেতুমন্ত্রী বলেন, পুলিশ দেখায় কত মামলা হয়েছে, কত জরিমানা করেছে। এগুলো আমার কাছে কোনো বিষয় না। আমার কাছে বিষয় হচ্ছে সড়ক নিরাপদ আছে কি না, সড়কে দুর্ঘটনা কমেছে কি না। গাড়ির ফিটনেস আছে কি না। চালকের ফিটনেস আছে কি না। গাড়ি ওভার স্পিডে আছে কি না, চালক গাড়ি চালানোর যোগ্য কি না- এগুলো আমার দেখার বিষয়।
প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে, পাখির মত মানুষ মরছে, মাছির মত মানুষ মরছে। এই মর্মান্তিক দৃশ্যগুলো মানুষ হিসেবে আমি সইতে পারি না। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি, রাতে দিনে, বৃষ্টিতে-রোদে-শীতে রাস্তায় ঘুরেছি। কিন্তু কাঙ্খিত ফল পাইনি। কিন্তু সড়কের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তাই এবার সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে হবে। রাস্তাকে নিরাপদ করতে হবে। পরিবহনে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
রামপুরা থেকে আগে নিয়মিত রাইদা পরিবহনের বাসে নিকুঞ্জে অফিসে যেতেন মিজানুর রহমান। কিন্তু এখন তিনি পারতপক্ষে ওই পরিবহনটি এড়িয়ে চলেন। তার বাসা থেকে অফিস রুটে পরিবহনটি বেশ জনপ্রিয় হলেও তিনি সবসময় বিকল্প খোঁজেন। কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পরিবহনের প্রতিটি বাসের মধ্যে চলে ভয়ানক এক প্রতিযোগিতা। দুবার বাসের ভেতরেই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন তিনি। এরপর থেকে তিনি পরিবহনটি এড়িয়ে চলেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী মিজানুর রহমান বলেন, একবার বাসের মাঝামাঝি জানালার পাশে বসা অবস্থায় রাইদা পরিবহনের আরেকটি বাসের চাপায় মাথায় আঘাত লাগে। আরেকবার নামার সময় দ্রুত বাস ছেড়ে দেওয়ায় সিঁড়িতে পড়ে যাই। তখন চালকের সহযোগী (হেলপার) আমাকে বাঁচায়। দুই দফায় দুই বাসের প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হই।
শুধু রাইদা পরিবহন নয়, গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে কথা বলে এমন অনেক পরিবহনের নামে অভিযোগ মিলেছে। সারকথা হলো— দিন দিন আরও বাড়ছে এই অশুভ প্রতিযোগিতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো, আগে পৌঁছালে আগে ট্রিপ দেওয়া এবং চালক ও স্টাফদের অজ্ঞতা-মাদকাসক্তি এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এজন্য দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাত্রী-পথচারী থেকে শুরু করে খোদ বাসেরই স্টাফরা।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি মোড়ে অবস্থান নিয়ে দেখা যায়, সামনের বাস না সরলে পেছনের বাস বারবার সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানির বড় বাস একটার পেছনে আরেকটা লেগে আছে। অন্যান্য রুটের মিনিবাস একটা আরেকটার সামনে গতিরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতি স্ট্যান্ডে চালকরা বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি রাখেন ও গাড়িতে যাত্রী ওঠান। বাসের সব সিট পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ স্ট্যান্ড ছাড়তে চান না। যাত্রীদের চাপাচাপিতে বাস যখন অন্য স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যায় তখন এর গতি থাকে বেপরোয়া। সবার আগে পরবর্তী স্টপেজে পৌঁছানোর চেষ্টা থাকে প্রতিটি বাসের।
পল্টন মোড়ে ফাঁকা রাস্তায় ভিক্টর পরিবহনের একটি বাস আকাশ পরিবহনের আরেকটি বাসকে যেতে বাধা দিতে দেখা যায়। কারণ দুটি বাস একই রুটের। এ পরিস্থিতিতে পেছনে আটকা পড়ে আরও কয়েকটি বাস। ফলে সড়কে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। সবকিছু দেখা যায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রকদের সামনেই। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে দেখা যায় না।
জানতে চাইলে কর্তব্যরত ট্রাফিক কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এরা কেউ আমাদের কথা শোনে না। শুধু সার্জেন্ট দেখলে জরিমানার ভয়ে ঠিক হয়। যে মোড়ে সার্জেন্ট থাকে সেখানে সব ঠিক। না থাকলেই বেপরোয়া।’
এদিকে, রাজধানীর নির্ধারিত বাস স্টপেজ ছাড়া অন্য কোথাও বাস না থামানোর নির্দেশ থাকলেও বেশিরভাগ চালক তা মানেন না। প্রতিযোগিতার কারণে সেই নির্দেশ অমান্য করে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করছে পরিবহনগুলো। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ওয়েবিল চেকের নামে বাস থামিয়ে রাখা হয়। এতে সড়কে বাড়ে যানজট।
গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশি যাত্রী ও মুনাফার লোভে কে কার আগে যাবে এ নিয়ে চালকদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। আবার অনেকক্ষেত্রে যাত্রীদের কারণেও প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিকাশ পরিবহনের বাসচালক রফিক মিয়া বলেন, ‘রাস্তা ফাঁকা থাকলে ধীরে-সুস্থে যাওয়ার উপায় নেই। তখন যাত্রীরা চিল্লায়। কয়, দুর মিয়া পেছনের গাড়ি আগে যায়, তুমি ঠেলাগাড়ি চালাও।’
রুটের পেছনের গাড়ি আগে পৌঁছালে যাত্রীদের মতো কোম্পানির লোকও নেতিবাচক মন্তব্য করে বলে জানান সিটি পরিবহনের এক চালক। তিনি বলেন, ‘দেরি হলে ট্রিপ মিস হয়। কন্ট্রাক্টর-হেলপারসহ অন্যান্য স্টাফরা গালিগালাজ করেন। আমাদের সমস্যা হয়। চাকরি থাকে না।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্যাহ বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত মালিক ও শ্রমিকদের সতর্ক করে যাচ্ছি। চলাচলের সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে বলছি। কিন্তু সিটির মধ্যে সেটা এখনও সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে বাস পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকবে না বলে জানান তিনি।


বিজ্ঞাপন