নিজস্ব প্রতিবেদক : শুক্রবার ১১ আগস্ট, রাজধানীর তেজগাঁওস্থ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করা হয়। এ ছায়া সংসদে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ পর্যায়ের সনামধন্য ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিতার্কিকরা অংশগ্রহণ করবে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি যৌথভাবে এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব টিপু মুনশি এমপি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান এবং সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারসহ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালকগণ, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকগণ, ইডেন মহিলা কলেজ ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যের শুরুতে শোকের মাস আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের শহীদ সকল সদস্যদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। অত:পর তিনি ব্যস্ততার মধ্যেও অনুষ্ঠানে সময় দেয়ার জন্য অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিকে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আয়োজনের জন্য ডিবেট ফর ডেমোক্রেসিকে এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় অধিদপ্তর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন ভোক্তাদের সচেতনতা। ভোক্তারা যতদিন পর্যন্ত তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হবে ততদিন পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
তিনি আরও বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য অধিদপ্তরে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি কর্তৃক প্রস্তাব প্রেরণ করা হলে তা অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ উত্থাপন করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি এমপির নেতৃত্বে পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। সে প্রেক্ষিতে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির সাথে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ পর্যায়ের সনামধন্য ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিতার্কিকরা অংশগ্রহণে বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
এ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী কাজের সূচনা হলো আজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। ৪ (চার) টি রাউন্ডে মোট ৭ (সাত) পর্বে এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হবে। তিনি আরও বলেন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অধিদপ্তরের সার্বিক কার্যক্রমের সমালোচনা করা হবে। আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সমালোচনাকে স্বাগত জানাব এবং তা নোট করে প্রয়োজন সাপেক্ষে অধিদপ্তরের কার্যক্রম সংশোধন করা হবে।তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে একটি ভোক্তাবান্ধব ও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করার জন্য সকলের সমন্বিত সহযোগিতা প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রী শুরুতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসিকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, দুই দলের বিতার্কিকদের বক্তব্য শুনে আমি অভিভূত। আমরা যে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম আমি মনে করি তা এই তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি আজকের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দুই দলই বিজয়ী হয়েছে।তিনি আলোচনায় বলেন, আইনের পাশাপাশি যে শিক্ষা মানবিক হতে শেখায়, যে শিক্ষা অসৎ হতে বাঁধা দেয় এমন শিক্ষা প্রয়োজন; প্রয়োজন এমন মূল্যবোধের। তিনি আরও বলেন আমাদের উৎপাদক কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ দেখতে হবে। পণ্যের মূল্য এমন হতে হবে যেন উৎপাদক কৃষক সন্তুষ্ট হয় আবার ভোক্তাগণও তা কিনতে পারে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে সিন্ডিকেট কাজে আসবে না। কেউ অসৎ উপায়ে সিন্ডিকেট করে পণ্যের মূল্য ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে তাকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি ব্যবসায়ীদের মানবিক ও সংবেদনশীল হওয়ার অনুরোধ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, মানুষ তার প্রয়োজনের তাগিদেই বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনছে। আর কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষের চাহিদাকে পুঁজি করে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও অনেক সময় অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভোক্তা অধিকার আইনের আধুনিকায়ন করাসহ অধিদপ্তরের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ব্রয়লার মুরগীসহ বেশ কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ৫/৬টি কর্পোরেট কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।এছাড়াও মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজারে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধির কারসাজির সাথে যে সকল বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেট কোম্পানীগুলি জড়িত সেগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। দেশে ডিম ও ব্রয়লার মুরগীর দামের অস্থিরতা তৈরির সাথে যে কয়টি কর্পোরেট কোম্পানী জড়িত তাদেরকে কড়া নজরদারির আওতায় আনতে হবে। প্রান্তিক খামারিরা কর্পোরেট কোম্পানীগুলোর কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
এসব প্রান্তিক খামারীদের বাঁচিয়ে রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাজারে এখন প্রায় প্রত্যেকটি নিত্যপণ্যের দামই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর টেস্ট বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকে পথে পথে বিভিন্ন সংগঠন, সমিতি চাঁদা দিতে হয় ।বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উৎসবের সময় পণ্যের দামে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়।কিন্তু আমাদের দেশে মুনাফালোভী, সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। আইন দিয়ে এ ধরণের প্রবণতা বন্ধ করা খুবই কঠিন। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবিক মূল্যবোধ, সুশাসন, নৈতিকতা, বাণিজ্যিক কূটনীতিসহ আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অত্যন্ত সাহসিকতা ও সততার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। খেয়াল রাখতে হবে ভোক্তা অধিকার যাতে ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ না হয়ে যায়। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতার মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার আদায়ে সামাজিক জাগরণ তৈরি করতে হবে।শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়,র্যাব, পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে দ্রব্যমূল্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা যাবে না। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এর সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ নিম্নবর্ণিত ১০ দফা সুপারিশ করেন সুপারিশ সমুহ যথাক্রমে,
“”দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রদান করা। একই সাথে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী ইশতেহারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি প্রদান করা।
ভোক্তা অধিকার আইনকে আরো আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করা।
মজুদদারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা
সকল সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে বাজারে দ্রব্যমূল্য পরিবীক্ষণ করা।
ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করার সময় ব্যবসায়ী প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্ত রাখার বিষয়ে নিশ্চিত করা
অনলাইনে শুনানির মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা।
ভোজ্যতেল, ডিম, ব্রয়লার মুরগী, ধান, চালসহ ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারসাজির সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তৈরি করে দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা করা।
পণ্যের নিরাপদ সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা।
ব্যবসায়ীদের জন্য ভোক্তা অধিকার বিষয়ক অরিয়েন্টেশন কোর্স চালু করা এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ কোর্সে ভোক্তা-অধিকার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা।
ভোক্তা অধিকার আইনের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাসহ সিন্ডিকেট কালোবাজারীর মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির শাস্তি টিভিসি, বিলবোর্ডসহ বড় বড় বাজারগুলোর সামনে প্রদর্শন করা।””
আজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর “শুধু আইন দিয়ে ভোক্তা-অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়” শীর্ষক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ইডেন মহিলা কলেজ ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-এর বিতার্কিকগণ অংশগ্রহণ করেন।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ইডেন মহিলা কলেজ সরকারি দল হিসেবে বিষয়ের পক্ষে বিতর্ক করেন এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী দল হিসেবে বিষয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করেন।
প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক মাঈনুল আলম, সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা এবং সাংবাদিক রেফায়েত উল্লাহ মীরধা প্রমূখ।
“শুধু আইন দিয়ে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়” শীর্ষক ছায়া সংসদে বিষয়ের পক্ষের দল ইডেন মহিলা কলেজ বিষয়ের বিপক্ষের দল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরাজিত করে আজকের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।