নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুরের জয়দেবপুরে সংকেতের (সিগন্যাল) ভুলে দুই ট্রেন এক লাইনে এসে মুখোমুখি সংঘর্ষের পরের দিন গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমে একই ভুল হয়েছে। ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস ও ঢাকা-রাজশাহীর ধূমকেতু এক্সপ্রেস সিগন্যালের ভুলে এক লাইনে এলেও অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। শুধু এ দুটি নয়, ভুল সংকেতে নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা।
প্রায় পৌনে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে গত এক মাসে তিনবার ভুল সংকেতের ঘটনা ঘটেছে। শুক্র ও শনিবারের ঘটনা ঘটেছে উন্নয়ন প্রকল্প চলমান এলাকায়।
কেন ভুল হচ্ছে : রেলের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী গণমাধ্যমে বলেছেন, বছরের পর বছর এসব প্রকল্প চলায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় কম্পিউটারভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা তথা কম্পিউটারবেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম (সিবিআইএস) নেই। সনাতন পদ্ধতির নন-ইন্টারলিঙ্ক ব্যবস্থায় মানুষ সংকেত দেন। মানুষ কাজ করলে ভুল হবেই। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, পুরোনো সংকেত (ম্যানুয়াল) পদ্ধতিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি নতুন নিয়োগ পাওয়া জনবল। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ঠিকাদারের সরবরাহ করা পয়েন্টসম্যান রেলের বিশেষায়িত কাজ জানেন না। এসব কারণে ভুল হচ্ছে।
রেলের মহাপরিচালক বলেছেন, অর্ধেক জনবল দিয়েছে সংস্থাটি। সিবিআইএসে দু’জন কর্মী লাগলে সনাতনে লাগে পাঁচজন। যারা নতুন আসছেন, তারাও দক্ষ নন। শিখিয়ে-পড়িয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। সিগন্যালের ভুল রোধে এখন থেকে কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। এতে ট্রেন চলাচলে বিলম্ব হলে কিছু করার নেই। যাত্রীদের নিরাপত্তা সবার আগে।
রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিবিআইএসে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সংকেত দেওয়া হয়। লাইন পরিবর্তনের সময়, পয়েন্ট ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ট্রেনকে চলাচলের অনুমতি দেয় না সিবিআইএস। কিন্তু পুরোনো পদ্ধতিতে পয়েন্টসম্যানরা ট্রেনকে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে নিতে পয়েন্ট তৈরি করেন। এতে ভুল হওয়া এবং স্টেশন মাস্টাররা সঠিক সংকেত দিতে না পারায় দুই ট্রেন এক লাইনে চলে আসার ঘটনা ঘটছে। আবার পয়েন্ট ঠিকভাবে তৈরি না হওয়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে।
রেলের লোকোমাস্টারদের (চালক) সূত্র জানিয়েছে, শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশনে মৈত্রী ও ধূমকেতু এক্সপ্রেসের ক্রসিংয়ের কথা ছিল। ঢাকামুখী মৈত্রী এক্সপ্রেস স্টেশনের ৫ নম্বর লাইনে দাঁড় করানো হয়। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ৪ নম্বর লাইন দিয়ে মৈত্রী এক্সপ্রেসকে অতিক্রমের কথা ছিল। কিন্তু ধূমকেতু সংকেতের ভুলে ৫ নম্বর লাইনে ঢুকে পড়লে মৈত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের উপক্রম হয়। তবে গতি কম থাকায় চালক মৈত্রী থেকে ৩০-৪০ গজ আগে ধূমকেতুকে থামাতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশনের নথি (০৮৯৫০৩ নম্বর) অনুযায়ী, স্টেশনের সিগন্যাল খারাপ হয়ে গেছে। চালককে হাত দেখিয়ে সংকেত দিয়ে স্টেশন পার হতে বলা হয়েছিল।
উন্নয়ন প্রকল্প ভোগাচ্ছে : রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার সমকালকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশনে দুই ট্রেন এক লাইনে চলে আসার ঘটনা শুনেছি। যমুনায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য ট্রেন চলাচলে মাত্র দুটি লাইন সচল রয়েছে। সেখানে সিবিআইএস নেই। থাকলে দুই ট্রেন এক লাইনে আসতে পারত না। জয়দেবপুরেও নতুন রেললাইন নির্মাণ চলছে, নেই সিবিআইএস।
এক দশক ধরে ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। এক যুগে প্রায় সম্পন্নের পথে কক্সবাজার রেলপথ। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকাসংলগ্ন টঙ্গী জংশনও চলছে সনাতন সংকেত পদ্ধতিতে। ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অর্থছাড়ে ধীরগতি এবং অন্যান্য জটিলতায় ঠিকাদাররা সময়মতো বিল পাচ্ছেন না। এতে কাজ এগোচ্ছে না। প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিবিআইএস চালু করা সম্ভব নয়।
পশ্চিমাঞ্চলের জিএম গণমাধ্যম কে জানান, ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের কারণে শনিবার যমুনা পূর্ব স্টেশনে তিন ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। সেখানেও সিবিআইএস নেই।
ঠিকাদারের সরবরাহ কর্মীর নেই দক্ষতা : কম্পিউটারভিত্তিক সংকেত ব্যবস্থা চালুর আগে ট্রেন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলত। তখন এত ঘন ঘন সংকেত ভুল না হলেও এখন কেন হচ্ছে– প্রশ্নে মহাব্যবস্থাপক বলেছেন, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া জনবলের দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। আবার নিয়মিত লোক বদল হয়। ১৬ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারী নিয়োগে ২০১৮ সালে সরকার আউটসোর্সিং নীতিমালা করে। এ পদ্ধতিতে ঠিকাদারের সরবরাহ করা কর্মীরা বেতন পেলেও অন্যান্য ভাতা ও পেনশন দিতে হয় না। সরকারের খরচ সাশ্রয় হয়। গত বছর রেলে পয়েন্টসম্যানসহ বিভিন্ন পদে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ শুরু হলে রেলের মতো বিশেষায়িত সংস্থায় অপ্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগে ঝুঁকি বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন। ঠিকাদারের সরবরাহ করা কর্মীর চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় দক্ষ জনবল গড়ে উঠবে না, আবার দায়বদ্ধতাও থাকবে না।
নিয়োগবিধির ১৪৩ নম্বর পদ পয়েন্টসম্যান। বিধিতে বলা হয়েছে, এ পদের ৫০ শতাংশ সরাসরি ও বাকিটা পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। সরাসরি নিয়োগে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। পদোন্নতিতে পাঁচ বছর নিম্নপদে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু রেল এ পদেও আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ দিয়েছে। তবে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সরকারের নির্দেশে এ পদ্ধতিতে কর্মী নিতে হয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের কর্মী বেতন পান ঠিকাদারের মাধ্যমে। রেলওয়ে প্রতি কর্মীর জন্য সোয়া ১৭ হাজার টাকা দিলেও ঠিকাদাররা কর্মীদের সাত-আট হাজার টাকা দিয়ে বাকিটা নিজেরা নেন। রেলের চলমান প্রকল্পেও এমন ঘটনার নজির রয়েছে। আবার কাজে নেওয়ার সময় কর্মীর কাছ থেকে জামানতের নামে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। আর্থিকভাবে শোচনীয় অবস্থায় থাকা কর্মীরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারেন না।
দক্ষরাও ভুল করছেন : গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ দিকে আউটারে দাঁড়ানো ছিল জ্বালানি তেলবাহী মালগাড়ি। টাঙ্গাইল থেকে আসা কমিউটার ট্রেন পাশের লাইন দিয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংকেতের (সিগন্যাল) ভুলে মালগাড়ি যে লাইনে ছিল, তাতে চলে গেলে কমিউটার ধাক্কা খায়। এতে দুটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৯টি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পরই স্টেশনমাস্টার ও দুই পয়েন্টসম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেলওয়ে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি হয়েছে। রেলের মহাপরিচালক বলেছেন, স্টেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি ২০ বছরের অভিজ্ঞ। কিন্তু রেললাইনে যারা কাজ করছেন, তারা সংকেত অনুযায়ী পয়েন্ট বানাতে পারছেন না।
ভুল সংকেতের জেরে শিডিউল তছনছ : জয়দেবপুরে দুর্ঘটনার জেরে গতকালও জংশনটি হয়ে চলা উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব ট্রেন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিলম্বে চলেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সকাল ৭টায় যাত্রা করে রাজশাহী হয়ে বনলতা এক্সপ্রেস ঢাকার কমলাপুরে পৌঁছার কথা বেলা ১১টায়। সময়সূচি অনুযায়ী, দুপুর দেড়টায় ট্রেনটি ফের চাঁপাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করবে। কিন্তু গতকাল বিকেল পৌনে ৬টার দিকেও কমলাপুরে আসেনি বনলতা। একই অবস্থা ঢাকা-রাজশাহী রুটের সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের। ট্রেনটির দুপুর ১টা ২০ মিনিটে কমলাপুরে আসার কথা। ফের রাজশাহীর অভিমুখে যাত্রা করবে দুপুর আড়াইটায়। কিন্তু বিকেল ৬টার সময়েও ট্রেনটি কমলাপুরে আসেনি। এ দুটিসহ অন্য ট্রেনগুলোর বিলম্বে স্টেশনে আটকা পড়া হাজার হাজার যাত্রী তীব্র গরমে দুর্ভোগ পোহান। বনলতা এক্সপ্রেসের যাত্রী সোহেল রানা বলেছেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুপুর ১২টা থেকে বসে আছি। পাঁচ ঘণ্টায় শিশুসন্তান দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাত বছরের নুসাইবা গরমে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার গণমাধ্যমে বলেছেন, শুক্রবারের দুর্ঘটনার কারণে ট্রেন চালাতে সমস্যা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাঁচ-ছয়টি ট্রেন বিলম্বে ছেড়েছে। কারণ, ট্রেনগুলো বিলম্বে ঢাকায় ফিরেছে।
এদিকে আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ৩২ ঘণ্টায় উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জয়দেবপুরে উভয় লাইন চালু হয়। উদ্ধার-সংশ্লিষ্টরা জানান, মালগাড়ির বগিগুলোতে জ্বালানি তেল থাকায় উদ্ধারকাজ হয়েছে ধীরগতিতে। টাঙ্গাইল কমিউটারের তিন বগি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুটি বগি একটি অপরটির ভেতরে ঢুকে গেছে।