মৌসুমী দাস, (রাজশাহী) : ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতু পরিবর্তনের পালাবদলে আসে শরৎ। শরৎ আগমনের অন্যতম প্রতীক কাশফুল আর নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘের ভেলা। শরৎ আমাদের মাঝে বিভিন্ন উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। এ সময় সনাতন সম্প্রদায়ের শারদীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরন রং মেশানো শেফালী, টগর আর শিউলিফুল। গাছে গাছে নানা রং এর ফুল আর বিলে শাপলার সমারোহ। সকালে শিশিরভেজা ফসলের মাঠে পাকা ধানের ডোগায় সোনালী রোদ গলে গলে পড়ছে। ধানক্ষেতের পাতায় শিশিরবিন্দু জানান দিচ্ছে শীত আসছে। গাছপালা বৃক্ষ হয়ে উঠেছে সতেজ ও সুন্দর। শরৎকালের প্রকৃতিতে এ যেনো এক অনন্য রূপ।
ধানক্ষেত হয়ে ওঠে চোখ ধাঁধানো সবুজ প্রান্তর। নদীর তীরে কাশবনে উঁকি দেয় সাদা সাদা কাশফুল। ভোরবেলা শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাসের ওপরে চাদরের মতো বিছানো থাকে সুমধুর ঘ্রাণ মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ার মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
প্রকৃতির রানি শরৎ ফুলেরও ঋতু। অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। এ ঋতুর রয়েছে আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুঘ্রাণে এ সময় ফোটে গগন শিরীষ, ছাতিম, বকফুল, শেফালি, শিউলি, কলিয়েন্ড্রা, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতী ইত্যাদি। যারা শরতের সঙ্গী হয়ে মন ভরায় সৌন্দর্য পিপাসুদের।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়, এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে। শরতের অন্যতম আকর্ষণ কাশফুল। নদী তীরে বনের প্রান্তে কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।
শরৎকালে প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কাশফুল। আর তাইতো কাশবনে ছুটে বেড়ায় দর্শনার্থীরা। সৌন্দর্য উপভোগে মেতে ওঠে প্রকৃতি প্রেমীরা। গগনে শুভ্র মেঘের ভেলা আর নদীতটে সাদা কাশফুল, মালার মতো আকাশগঙ্গায় উড়ে চলা পাখির ঝাঁক, সকালবেলা হালকা শিশিরভেজা সবুজ ঘাস আর শিউলিতলায় সুঘ্রাণ মাখানো শিউলিফুল, নরম রোদের ঝলমলে আলো। সব মিলিয়ে শরৎ যেন নির্মলতার ঋতু। শরতের রাতে দেখা মেলে জ্যোৎস্নার মোহনীয় রূপ। সাহিত্যের অনেকাংশ জুড়ে আছে শরৎকাল যার সবটুকুই উৎসব আর আনন্দের। এ সময় বুড়োবুড়িরা ছোটদের কিচ্ছা শোনায় জ্যোৎস্না রাতে।
শরৎ উৎসবেরও ঋতু। শিউলির মিষ্টি সুবাসে যেন দেবী দুর্গার আগমনকে ইঙ্গিত দিতে থাকে। শরতের মূল আকর্ষণ দুর্গাপূজা। যা বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব। সমগ্র বাংলাজুড়ে পালিত হয় এ উৎসব।
শরৎকালে এ পুজো হয় বলে দুর্গাপূজাকে শারদীয় উৎসব বলা হয়। এ ঋতুতে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। দেবী দুর্গার আগমনের জন্য তারা সারাবছর অপেক্ষায় থাকে। সেই অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে দেবী দুর্গা শরতের আশ্বিনে নিয়ে আসেন অনাবিল আনন্দ। বাংলার আকাশে বাতাসে মুখরিত হয় দেবী দুর্গার আগমনধ্বনি। উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বাংলার মানুষজন। পুজোর সময়ে স্কুলে ছুটি থাকায় ছোটদের মধ্যে আনন্দের সীমা থাকে না।
বাংলার প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা ছাড়াও এসময়ে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা উদযাপিত হয়। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গার আরাধনা ও বিসর্জন শেষে আগমন ঘটে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর। কিছুদিন পরই রাতের আকাশে আতশবাজির ঝলকানি নিয়ে আসে দীপাবলি উৎসব। শরতের এই সময়ে গ্রামীণ বধূরা নাইওর, অর্থাৎ পিত্রালয়ে গমন করেন। অনেকের মতে, শরৎকালে নাকি ভালোলাগার অনুভবে মনটা নেচে ওঠে। ছুটির নেশা, উৎসবের নেশায় মন ছুটে যায়।
এই শরৎ থাকবে না। প্রকৃতির নিয়মে এসেছে, প্রকৃতির নিয়মেই চলে যাবে। আফসোস করার আগে একটু হৃদয় মেলে শরৎকে দেখা যেতে পারে। এই উতাল হাওয়ায় কি অপরূপ সেজেগুজে রয়েছে শরৎ রানি।